লেখক: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির অন্যতম আকর্ষণ কুতুব মিনারের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি অস্বীকার করলেও কুতুব মিনার এলাকায় নতুন করে খননকাজ করা হবে কি না, তা নিয়ে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লির নিম্ন আদালতে রুজু হয়েছে একাধিক মামলা। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হাত গুটিয়ে নিলেও আদালতের রায়ে ওই এলাকার ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ হবে কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
একাধিক প্রাচীন স্থাপত্যের ধর্মীয় চরিত্র ঘিরে ভারতের রাজনীতি এই মুহূর্তে সরগরম। এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাজমহলের বন্ধ কপাট খোলার আরজি প্রথম শুনানিতে খারিজ করে দিলেও অন্যান্য ঐতিহাসিক ও প্রাচীন স্থাপত্য ঘিরে জটিলতা কাটেনি। কাশীর জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে মামলার প্রাথমিক শুনানি আজ সোমবার শেষ হয়েছে।
আগামীকাল মঙ্গলবার জেলা জজ জানাবেন কোন আবেদনের শুনানি প্রথম হবে।
মথুরায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের ভাগ্যও ঝুলে রয়েছে স্থানীয় আদালতে। এর মধ্যে কুতুব মিনার নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জল্পনা। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের তৈরি এই সুউচ্চ মিনার চত্বরে একদা হিন্দু মন্দিরের অবস্থান ছিল কি না, তা হতে চলেছে আদালতের বিচার্য বিষয়। গত সপ্তাহে খবর রটে, কেন্দ্রীয় সরকার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) কুতুব মিনার চত্বরে নতুন করে খননের দায়িত্ব দিয়েছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি গত রোববার সেই খবর অস্বীকার করলেও দিল্লির নিম্ন আদালত যে সেই নির্দেশ দেবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা এই মুহূর্তে নেই।
কারণ, জ্ঞানবাপি মসজিদ মামলা খারিজ করে না দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহে বলেছেন, ১৯৯১ সালের কেন্দ্রীয় আইনে বলা নেই, কোনো প্রাচীন স্থাপত্যের ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে না। এ মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট জ্ঞানবাপি মসজিদ মামলাটি বিচারের জন্য বারানসি জেলা আদালতের কাছে পাঠিয়েছেন।
আর সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশে বিশিষ্ট রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী কিছুটা বিস্মিত। এ বিষয়ে আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘স্পর্শকাতরতার কথা বিবেচনা করেই ১৯৯১ সালের ওই আইন তৈরি হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলার রায়েও তার সবিস্তার উল্লেখ করেছিলেন। এখন কী কারণে জ্ঞানবাপি মামলায় এ মন্তব্য করা হলো বলা কঠিন। কারণ, চূড়ান্ত রায় সর্বোচ্চ আদালত দেননি।’ তিনি বলেন, ‘আইনের বিষয়টি পাশে সরিয়ে রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে মনে হচ্ছে, শাসক দল ২০২৪ সালের ভোটের পৃষ্ঠভূমি তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছে এবং সেটি তারা করতে চাইছে আইনি পথে।’
সুপ্রিম কোর্টের ওই যুক্তি মেনে কুতুব মিনার–সংলগ্ন এলাকার ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণে দিল্লির নিম্ন আদালত রায় দিলে হিন্দুত্ববাদীদের পালে নিশ্চিতভাবে আরও হাওয়া লাগবে। কারণ, এই মহলের দাবি, মোট ২৭টি মন্দির ভেঙে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক কুতুব মিনারসংলগ্ন স্থাপত্য গড়েছিলেন। তাঁদের আরও দাবি, ওই চত্বরে থাকা দেব–দেবীর মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজার অনুমতি দেওয়া হোক। এদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও দাবি জানিয়েছে, কুতুব মিনার যে জায়গায় তৈরি, একসময় সেখানে ছিল বিষ্ণুর মন্দির। অতএব ওই মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ ঘোষণা করা হোক।
এ ধরনের বিভিন্ন ধর্মীয় দাবি হঠাৎই দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে উঠতে শুরু করেছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, এবারের ঈদে রাজ্যের কোথাও রাস্তায় নামাজ পড়তে দেওয়া হয়নি। ১ লাখের বেশি লাউডস্পিকার খুলে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের মাইকের আওয়াজ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন, সরকারি অনুদান পাওয়া সব মাদ্রাসা তিনি বন্ধ করে দিতে চান এবং সেটা মুসলমানদের জন্যই মঙ্গলজনক। তাঁর কথা, ধর্মশিক্ষার জন্য বাড়ি রয়েছে। স্কুলে বিজ্ঞান পড়তে হবে। অঙ্ক পড়তে হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। বিরোধী মহলের একাংশের ধারণা, ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে সরকার শেষ পর্যন্ত ধর্মস্থানের চরিত্র অপরিবর্তিত রাখতে ১৯৯১ সালের কেন্দ্রীয় আইন খারিজের রাস্তায় হাঁটতে পারে। আইন প্রণয়নের মতো আইন খারিজের অধিকারও সরকারের আছে। সে জন্য বিল এনে তা পাস করাতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,