লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
১৯৯৬ সালের আগস্ট। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন হয়েছে ইসলামাবাদে। দাওয়াত পেয়ে আমিও হাজির। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে গেলাম। যখন পাকিস্তানি ছিলাম, তখন পাকিস্তান দেখা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে গেলাম এমন একটি দেশে, যার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ ছিলাম ২৩-২৪ বছর। এই সফর নিয়ে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ ও কৌতূহল।
সারা দিন বৈঠক-বক্তৃতায় সময় কাটে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, পানাহার। এদের অনেকেই আমার পূর্বপরিচিত। আড্ডাবাজি সাঙ্গ হলে কামরায় গিয়ে বিশ্রাম নিই। যতক্ষণ না ঘুম আসে, টেলিভিশন দেখি। আমার আগ্রহ সংবাদে। আর কয়েক দিন পর উদ্যাপিত হবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস—১৪ আগস্ট। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান কর্মসূচি। সরকারিভাবে উদ্যাপন করা হচ্ছে বছরব্যাপী স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী, যা শেষ হবে পরের বছর ১৪ আগস্ট।
কিন্তু সব ছাপিয়ে অন্য একটি সংবাদ আমার নজর কাড়ল। সংবাদের উৎস আফগানিস্তান। সংবাদে ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে—তালেবান নামের একটি গোষ্ঠী একের পর এক শহরে বিজয়রথ উড়িয়ে চলেছে। কাবুলে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট নাজিবুল্লাহর সরকার। আফগানিস্তানে ‘সোভিয়েত আক্রমণের’ বিরুদ্ধে মুজাহিদিন নামের ব্যানারে প্রতিরোধযুদ্ধ চলছে অনেক বছর ধরে। একপর্যায়ে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ‘তালেবান ইসলামি মুভমেন্ট অব আফগানিস্তান’। ধীরে ধীরে যুদ্ধের নেতৃত্ব তালেবানের হাতে চলে যায়। কারা এই তালেবান?
তালেব একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ অন্বেষণকারী। আমাদের দেশেও মাদ্রাসার ছাত্রদের তালেবুল এলেম বলা হয়। পশতু ভাষায়ও তালেব শব্দটি আছে। তালেবের বহুবচন হলো তালেবান। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ করছে। এরা দেশে শরিয়াহ আইনের ভিত্তিতে ইসলামি শাসন চায়। তালেবানের উত্থান হয় ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী শহর কান্দাহারে। এদের প্রধান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ উমর। সোভিয়েত–সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র, যারা বেড়ে উঠেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আফগান শরণার্থীদের জন্য তৈরি হওয়া শিবিরে। যত দূর জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় সৌদি আরবের টাকায় আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দেওয়া প্রশিক্ষণে এরা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। আফগানিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এখন নাম খাইবার পাখতুনখাওয়া) ও বেলুচিস্তানের পশতুভাষী জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি পায় তালেবান। কিছুদিনের মধ্যেই তারা কান্দাহার প্রদেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, গঠন করে ইসলামি এমিরেট অব আফগানিস্তান। পাকিস্তানে তখন পিপলস পার্টির সরকার। বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে হাতে গোনা যে কয়টা দেশ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়, পাকিস্তান তার অন্যতম।
১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে ধরে এনে ফাঁসি দিয়ে কাবুলের রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রাখে। তার কিছুদিন পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান বেনজির ভুট্টোর সরকারকে ‘দুর্নীতি ও অদক্ষতা’র অভিযোগে বরখাস্ত করেন। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয় পেয়ে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। তাঁর সময়েও তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন অব্যাহত থাকে।
প্রায় দুই দশক আগে ইরানে সংঘটিত হয়েছে ইসলামি বিপ্লব। ইরানে রেজা শাহ পাহলভির শাসনামলের অব্যাহত ‘পশ্চিমিকরণ’ ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন রূপান্তরিত হয়েছিল ‘ইসলামি পুনর্জাগরণ’ আন্দোলনে। এদের প্রধান শত্রু ছিল ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’। ইরান এখনো এই অবস্থান বজায় রেখেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় প্রচণ্ড মার্কিনবিরোধিতার সামনের কাতারে ছিল ভিয়েতনাম আর কিউবা। ভিয়েতনাম তার পুরোনো দ্বন্দ্বগুলো মার্কিনদের সঙ্গে মিটিয়ে ফেলেছে। এখন তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। মার্কিনবিরোধিতা অব্যাহত রেখেছে কিউবা ও ইরান। একটির ডকট্রিন হলো কমিউনিজম, অন্যটির ইসলাম।
আফগানিস্তান মার্কিনবিরোধী লড়াইয়ে নতুন এক ডাইমেনশন তৈরি করে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় আল–কায়েদা। তবে সাধারণ আফগানদের সঙ্গে আল–কায়েদার সংস্রব নেই। আফগানরা বরাবরই স্বাধীনচেতা। কোনো বিদেশি শক্তিকে তারা নিজেদের দেশে ঠাঁই দেবে না।
আফগানিস্তান নিয়ে পরাশক্তিগুলোর রেষারেষি নতুন নয়। এই দেশ নিয়ে জারের আমলের রাশিয়া আর ব্রিটিশ ভারতের লড়াই ছিল। অবশেষে তারা সমঝোতা করে যে আফগানিস্তান একটি ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে থাকুক। সেভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সোভিয়েতপন্থীরা ধরে নেয় যে আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়ছে। বিপ্লব হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের ১৩ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) এক সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশের ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে’ হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘কাবুলে বিপ্লব হয়েছে, বাংলাদেশও বিপ্লব ঘটিয়ে দেব।…১৯৭১ সালে ভারতবর্ষ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই আজ আফগানের বিপ্লবী জনগণ, আফগানের বিপ্লবী সরকার যখন সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিয়েছে, সেই সাহায্যকে সঠিক মনে করছি।’ ফরহাদ গ্রেপ্তার হয়ে যান।
নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে হটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে সরাসরি আক্রমণ চালায়। কয়েক মাসের মধ্যেই তালেবানকে হটিয়ে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় কাবুলে। প্রেসিডেন্ট হন হামিদ কারজাই। এর ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা সমর্থনে একধরনের ‘স্থিতিশীলতা’ তৈরি হয়েছিল বলে দাবি করা হলেও মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে সরে আসার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। তালেবান আবার বসে যায় চালকের আসনে।
যত দূর জানা যায়, বর্তমান তালেবান দুনিয়াব্যাপী ইসলামি শাসন কায়েমের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, যেমনটি ভাবে ইরান ও সৌদি আরব। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, চেচনিয়া নিয়ে তালেবানের মাথাব্যথা নেই। তাদের ভাবনায় শুধু আফগানিস্তান। মূল বিষয়টি হলো অন্য জায়গায়। প্রথম পর্যায়ের তালেবানি শাসনে যেভাবে ‘শরিয়াহ আইন’ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তার ফলে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক ও বিচ্ছিন্নতা। একুশ শতকে এসে এ ধরনের শাসনব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের ভেতরে যে ‘প্রতিরোধ’, তা গড়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। এটি আফগান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। গত ২০ বছরে এই ‘উদার গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা সাধারণ আফগানদের মনোজগৎ বদলাতে পারেনি, এটাই বাস্তব সত্য। জনসমর্থন না থাকলে তালেবান এত দ্রুততার সঙ্গে সারা দেশে তাদের ঝান্ডা ওড়াতে পারত না আর হাজার হাজার সরকার সমর্থক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেত না। প্রতিরোধের বদলে এই পলায়ন প্রমাণ করে যে গায়ের জোরে আমদানি করা ডকট্রিন দিয়ে মানুষের মন পাওয়া যায় না। এটা বুঝেছে রাশিয়া। এটা বুঝেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কাবুলের ‘পতন’ হয়েছে, না কাবুল ‘মুক্ত’ হয়েছে, তার বিচার হবে টেবিলের কোন পাশে কে বসেছে।
শরিয়াহ আইন নিয়ে প্রশ্ন আছে নানান দেশে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে বসে আমরা কীভাবে এর ব্যাখ্যা করব, যেখানে আমাদের দেশও অনেক ক্ষেত্রেই চলে শরিয়াহ আইনে। ১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, এ দেশে কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন হবে না। সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার আইনের ভিত্তি হচ্ছে শরিয়াহ। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছেন, কোনো নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে কি না, জানি না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় নারী কর্মকর্তার উপস্থিতি নিয়ে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ গিয়েছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত নাগরিক সমাজের চাপে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। আমরা কিছু ক্ষেত্রে শরিয়াহ আইনের বিরোধিতা করব আর কিছু মেনে চলব, এ রকম একটা অবস্থানে আছি। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরও জনমনস্তত্ত্ব এগোয়নি, বরং পিছিয়েছে, আশপাশ দেখলেই টের পাওয়া যায়। তারপরও আফগানিস্তান নিয়ে আমরা অনেকেই ভাবি।
লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
সূত্র : প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ৩০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,