শুক্রবার ডেইলি স্টার–এর প্রথম পাতায় প্রধান ছবিটি দেখে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। চার কলামজুড়ে ছাপা ছবিতে দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরা এক নারী রিকশা চালাচ্ছেন। পেছনে যাত্রীর আসনে যে পুরুষ বসে আছেন, তিনি একজন সবজি বিক্রেতা। সবজি নিয়ে যাচ্ছেন মিরপুর ১ নম্বরে।
দুদিন আগেও এই নারী কোনো বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সরকারের ঘোষিত লকডাউনের কারণে সেই কাজ হারিয়েছেন। লকডাউনের সময় অধিকাংশ ভদ্রলোক বাড়িতে গৃহকর্মী, হকার ও ড্রাইভারদের ঢুকতে দেন না। নিরুপায় হয়ে ৪৫ বছর বয়সী এই নারী রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। হয়তো সংসারে তিনিই একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি।
আগের দিন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেখলাম, লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে শার্ট–প্যান্ট পরা এক সুদর্শন তরুণ রিকশা চালাচ্ছেন। তিনি রাস্তায় টহলরত পুলিশের কাছে হাতজোড় করে বলছেন, তারা যেন রিকশাটি আটক না করে, তাহলে তাঁকে না খেয়ে মরতে হবে। এই তরুণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি টিউশনি করে পড়াশোনা ও নিজের জীবনযাত্রার খরচ মেটাতেন। করোনার কারণে তাঁর টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনিও বাধ্য হয়েছেন রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে।
গত এক বছরে এ রকম কত নারী-পুরুষ যে পেশা ও জীবিকা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন, তার হিসাব নেই। কত মানুষ যে কাজ হারিয়েছেন, তারও হিসাব নেই। হিসাব যাঁদের রাখার কথা, তাঁরা বোবা ও বধিরের ভূমিকা নিয়েছেন। রাষ্ট্রকে যদি জিজ্ঞেস করি, রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো এই নারীর কাছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কী অর্থ আছে? দেশ উন্নয়নশীল না মধ্য আয়ের পর্যায়ে উন্নীত হলো, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এই তরুণের, যিনি রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাঁর কী আসে যায়? তিনি জানেন, টিউশনি বন্ধ হয়ে গেলে রিকশা চালিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে। এই রাষ্ট্র তাঁর জন্য কিছু করবে না। সমাজের হোমরাচোমরা ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসবেন না।
সরকারের দাবি, বাংলাদেশ করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। এসব কি সাফল্যের নমুনা? সরকার যখন সাফল্যের রোমাঞ্চকর গল্প শোনাচ্ছে, তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালে বেড নেই, আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। রোগ পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট কেন্দ্র নেই। আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে স্বজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছেন।
এসবের পাশাপাশি ১২ এপ্রিল পিলে চমকানোর মতো খবর ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১ হাজার ৮০০ টেকনিশিয়ান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। চাকরিপ্রার্থীরা যথারীতি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেন। তবে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র আগেই ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো হয় বলে অভিযোগ আছে।
এরপর পরীক্ষকেরা দেখতে পান, যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় শতভাগ বা তার কাছাকাছি নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা মৌখিকে কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারেননি। যাঁরা কম নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা মোটামুটি সঠিক উত্তর দিয়েছেন। এতে দুই পরীক্ষকের সন্দেহ হয় এবং তাঁরা বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। নাটক এখানেই শেষ নয়। ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা খবরটি জানতে পেরে এক পরীক্ষককে প্রথমে এক কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, পরে আরও দেওয়া হবে।
রোম যখন পুড়ছিল, তখন সম্রাট নিরো নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। করোনায় যখন বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তা উৎকোচ–বাণিজ্যে মেতেছেন। এর আগে করোনা পরীক্ষা নিয়ে সাহেদ-সাবরিনাদের কেলেঙ্কারিও দেশবাসী দেখেছে। স্বাস্থ্য খাতের সর্বত্র দুর্নীতি ও অনিয়ম।
১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া লকডাউন কিংবা এর আগে ৫ এপ্রিল থেকে ঢিলেঢালা আরেক দফা লকডাউনের আগমুহূর্তে যে শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে চলে গেছেন, তার কারণ কি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন? করলে দেখতে পেতেন, জীবন–জীবিকার অনিশ্চয়তার কারণে তাঁরা ঢাকা বা অন্যান্য শহর ছাড়ছেন। তাঁরা জানেন, লকডাউন মানে রিকশাচালক রাস্তায় রিকশা নিয়ে নামতে পারবেন না, দিনমজুর কোনো কাজ পাবেন না, নির্মাণশ্রমিককে ঠায় ঘরে বসে থাকতে হবে। যেসব ভদ্রলোকের বাড়িতে গৃহকর্মীরা কাজ করেন, তাঁরা তাঁদের ঢুকতে দেবেন না। আমাদের দেশে ব্রিটিশ প্রবর্তিত জমিদারি উঠে গেছে অনেক আগে। কিন্তু শহুরে ভদ্রলোকদের জমিদারি বহাল আছে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অনেক অ্যাপার্টমেন্টে নোটিশ ঝুলতে দেখেছি, গৃহকর্মী ও ড্রাইভাররা লিফট ব্যবহার করতে পারবেন না। ভদ্রলোকদের লিফটে ড্রাইভার ও গৃহকর্মীরা উঠলে তাঁদের কৌলীন্য চলে যায়।
প্রতিবার লকডাউনের আগে গরিব মানুষেরা বাস, ট্রেন, লঞ্চে করে দলে দলে গ্রামে যান। ট্রেন বা লঞ্চ না থাকলেও তাঁরা হেঁটে, ভ্যানে বা রিকশায় চড়ে, ইজিবাইকে, ট্রাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূরের পথ পাড়ি দেন। কেননা তাঁরা জানেন, শহরে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এই শহরে মন্ত্রী আছেন, মেয়র আছেন, নেতা আছেন, আমলা আছেন, কাউন্সিলর আছেন, দলের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কর্মী আছেন। কিন্তু এসব দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষকে দেখার কেউ নেই।
আসলে কাদের জন্য এই রাষ্ট্র? কাদের জন্য এই সরকার?
৫ এপ্রিল থেকে সরকার সারা দেশে লকডাউন দিয়েছে, আর ৮ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ৩৫ লাখ পরিবারকে ঈদের আগে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কেন ৫ এপ্রিলের আগে এ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারল না? গত বছর সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে যে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল, তা–ও সবাই পাননি। ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ৩৬ লাখ পরিবারের কাছে এই সহায়তা পৌঁছেছে। বাকিরা পাননি। অনেক ক্ষেত্রে সচ্ছল ব্যক্তিদেরও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরে ধরা পড়ায় তাঁরা বাদ পড়েছেন। এবার ৩৫ লাখ পরিবারের কাছে এই সহায়তা পৌঁছাবে, তারই–বা নিশ্চয়তা কী?
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন। এই যেসব দিন আনা, দিন খাওয়া গরিব মানুষ, যাঁরা শ্রম দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সচল রেখেছেন, তাঁদের জন্য দুই বছরে রাষ্ট্রের সহায়তা মাত্র পাঁচ হাজার টাকা? সরকার বলছে, ঈদের আগে তাঁদের কাছে টাকা পৌঁছানো হবে। কিন্তু ঈদ পর্যন্ত তাঁরা কীভাবে চলবেন? যদি লকডাউন আরও প্রলম্বিত হয়? যদি তাঁদের জন্য শহুরে ভদ্রলোকদের দরজা বন্ধ থাকে? যদি তাঁরা রাস্তায় রিকশা নামাতে না পারেন? যদি বেচাবিক্রির জন্য ফুটপাতে বসতে না পারেন, তাহলে এসব মানুষ কী খাবেন?
আসলে রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁদের এতই হীনবল করেছে যে তাঁরা কোনো দর–কষাকষি করতে পারেন না। পারলে এসব মানুষ কণ্ঠে সর্বোচ্চ শক্তি ধারণ করে বলতেন, লকডাউনের আগে আমাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। কাজ হারালে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁরা বলতে পারতেন, এমন সরকার চাই না, যার ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, অথচ কিল দেওয়ার গোঁসাই সেজে বসে আছে।
লেখক: সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,