নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি ও হানাহানিতে লিপ্ত থাকলে দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে সতর্ক করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। হুঁশিয়ার করে তিনি বলেছেন, ‘আমি আজকে বলে দিলাম। নইলে বলবেন– সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।’ ২০০৯ সালে পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন। জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) ক্লাবের আয়োজনে রাজধানীর মহাখালীতে ক্লাবের হেলমেট হলে এ অনুষ্ঠান হয়।
এই দেশ আমাদের সবার– উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেছেন, আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, এর আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাও একমত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমেই বলেছিলাম ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা। আমার মনে হয়, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। উনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন।’
দেশ-জাতি যেন একসঙ্গে থাকতে পারে, সে লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তাচেতনার বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু দিন শেষে দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে আমরা সবাই যেন এক থাকতে পারি। তাহলেই এই দেশটা উন্নত হবে। দেশটা সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়তে যাব। বিশ্বাস করেন, ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেড, ওই দিকে আমরা যেতে চাই না।
তিনি আরও বলেন, এখানে যেসব উচ্ছৃঙ্খল কাজ হয়েছে, সেটা আমাদের নিজস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারড। আমরা নিজেরা এইগুলো তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনও শান্তিশৃঙ্খলা আসবে না– এই জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।
‘সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণ করবেন না’
সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি– সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারও কারও। কী কারণে? আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি। আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। অফকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স। নেভি চিফ আবার মন খারাপ করে আবার ইয়ে করছে। নেভি, এয়ারফোর্স উই অল। আমাদের সাহায্য করেন; আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। উপদেশ দেন; আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশাবাদ
দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের দিকে) ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার এদিকে হেল্প করবে।’ এ প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান আরও বলেন, ‘আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, হি কমপ্লিটলি এগ্রিজ উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর অর… (আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি তিনি সম্পূর্ণভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হওয়া উচিত এবং সেই নির্বাচন হওয়া উচিত ডিসেম্বরের মধ্যে) যেটা আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে, ১৮ মাসের মধ্যে একটা ইলেকশন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড বিডিআর সদস্যদের হাতেই
সেনাপ্রধান বলেন, পিলখানায় যে সকল চৌকস সেনাসদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তারা বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) গুলিতেই প্রাণ হারিয়েছেন। সেনাসদস্যদের হত্যার ঘটনা ও এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। তিনি আরও বলেন, এখানে কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ নাই। এখানে যদি ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ আনেন; যে বিচারিক কার্যক্রম এতদিন ধরে হয়েছে, তা ব্যাহত হবে। এই যে বিচারিক কার্যক্রম এতদিন ধরে হয়েছে, ১৬ বছর ধরে, ১৭ বছর ধরে যারা জেলে আছে, যারা কনভিকটেড। এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজন– এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।
সেনাপ্রধান বলেন, এখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে জড়িত ছিল কিনা, বাইরের কোনো শক্তি এর মধ্যে জড়িত ছিল কিনা, সেটার জন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশন সেটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন। বটমলাইন হচ্ছে– আমাদের এই চৌকস সেনাসদস্যরা যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তারা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা এ সমস্ত জিনিস নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
তিনি বলেন, আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, কোনো ব্যত্যয় থেকে থাকে, সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়ে কোনো লাভ হবে না, নিজের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না। আমি আপনাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করে দিচ্ছি। কিছু সদস্যের দাবি, তারা ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন, তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেই বোর্ডের সদস্য। প্রথম ধাপে ৫১ জন সদস্যের ব্যাপারে আমার কাছে রেকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। রেকমেন্ডেশনের অধিকাংশ আমি গ্রহণ করেছি। নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীও তাদের এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য কোনো ছাড় হবে না, বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের স্পষ্ট করে দিচ্ছি। এটা একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্স, ডিসিপ্লিনড ফোর্সকে ডিসিপ্লিনে থাকতে দেন। আজ দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সমস্ত বাহিনী, সমস্ত অর্গানাইজেশন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। খালি সেনাবাহিনী টিকে আছে। বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী টিকে আছে। কেন? বিকজ অব ডিসিপ্লিন। আমি আমার অফিসারদের আদেশ দিয়েছি, যদি সামান্যতম কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, যে কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে, অপরাধী কিনা, যদি সামান্য কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, সেটা তাদের ফেবারে যাবে। এটা হচ্ছে, আমার ঢালাও নির্দেশ।
আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আজকে একটু স্পষ্ট করে কথা বলতে চাই। আপনাদের সবার হয়তো ভালো লাগতে নাও পারে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এটা যদি গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। কোনো ক্ষতি হবে না দেশের। আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, একটাই আকাঙ্ক্ষা– দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে … এনাফ ওয়াজ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস ইজ এনাফ। আমি চাই দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।
‘আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত’
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে ‘কিছু কারণ’ তুলে ধরে সেনাপ্রধান বলেন, প্রথম কারণটা হচ্ছে, আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানে এই সময় যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে এটা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই– সব সংস্থাই অতীতে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। আজ দেশের যে স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে, এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছে। সেজন্য আজকে এতদিন ধরে একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। তবে অপরাধ করলে তার শাস্তিও যে হতে হবে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, না হলে সেই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজটা করব, এসব অর্গানাইজেশন যেন আন্ডারমাইন করা না হয়। আজ পুলিশ সদস্য কাজ করছে না। একটা বিশাল বড় কারণ হচ্ছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে। র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের বিরুদ্ধে গুম-খুনসহ ‘বিভিন্ন দোষারোপের’ তদন্ত চলছে জানিয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, অবশ্যই তদন্ত চলবে, দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন এ অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন না হয়।
এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন করে যদি আপনারা মনে করেন যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না। সেটা সম্ভব না, আমি আপনাদের স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ২ লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, র্যাব আছে, আনসার-ভিডিপি আছে। আমার আছে ৩০ হাজার সৈন্য। আমি ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে কীভাবে এটা পূরণ করব? ৩০ হাজার থাকে, তারা চলে যায় ক্যান্টনমেন্টে, আরও ৩০ হাজার আসে। এটা দিয়ে আমরা দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোয় রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘উনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন আজকে এখানে আপনাদের সঙ্গে এসে কথা বলার জন্য। একটু মন খুলেই কথা বললাম। এত দিন যে কথা মনের মধ্যে ছিল, সব সময় প্রকাশ করতে পারি না, প্রকাশ করাও যায় না। আজকে প্রকাশ করে ফেললাম।’
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আজকে একটা বেদনাবিধুর দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা এই ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসার এবং শুধু তা-ই নয়, তাদের কিছু কিছু পরিবারবর্গের সদস্যদের হারিয়েছি। এখানে আসার সময় এই ছবিগুলো আমি দেখছিলাম। এই ছবিগুলো আপনারা অনেকে ছবিতে দেখেছেন। কিন্তু এগুলো আমার সব চাক্ষুষ দেখা। আমি একটা চাক্ষুষ সাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার।’
অতিথিদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, আপনারা কিছু মনে করবেন না। আজকে আমি একটু পরিষ্কার করে কথা বলতে চাই। আপনাদের সবার হয়তো ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আমার এটা যদি আপনারা গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। কোনো ক্ষতি হবে না।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০২৫
রেটিং করুনঃ ,