লেখক: আতাউর রহমান।
রাজধানীর কলাবাগানের ফ্ল্যাট থেকে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান ওরফে লিপির লাশ উদ্ধারের পর দীর্ঘ সময়েও রহস্যের কূল মিলছিল না। অন্তত ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ আর প্রযুক্তিগত ও ম্যানুয়াল তদন্তের পরও অন্ধকারেই ছিলেন তদন্তকারীরা। শুরুর দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে ‘এটি হত্যাকাণ্ড’ বলা হলেও তদন্তে ‘কিছু না পেয়ে’ আত্মহত্যা হতে পারে বলেও সন্দেহ করতে থাকেন থানা পুলিশের তদন্তকারীরা।
কিন্তু পৌনে চার মাস পর জানা গেল, ওই চিকিৎসক পরিকল্পিত খুনের শিকার হয়েছিলেন। পাশাপাশি দুটি সিগারেটের টুকরার (উচ্ছিষ্টাংশ) সূত্র ধরে তদন্তে জ্বলে উঠেছে আশার আলো।
চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি কাগজে-কলমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও রহস্য উদ্ঘাটনে ডিবিসহ অন্যান্য সংস্থাও ছায়াতদন্ত শুরু করছিল। আলোচিত এই ঘটনায় ‘কিছু না পাওয়ায়’ শেষ পর্যন্ত মাসখানেক আগে তদন্তভার যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বিভাগে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগ।
এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও তদন্ত সংশ্নিষ্ট পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে বলছে, চিকিৎসক সাবিরার বাসার সিঁড়ি থেকে শুরু করে কক্ষ পর্যন্ত বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল সিগারেটের দুটি উচ্ছিষ্ট অংশও। ল্যাবে ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষায় এর একটিতে অজ্ঞাত এক পুরুষের ডিএনএ মিলেছে, অপরটি মাল্টিপল নমুনা। অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তির ডিএনএর উপস্থিতি রয়েছে ওই অংশে। এখন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে চেষ্টা হবে খুনি শনাক্তের, যার জন্য চলছে তালিকা তৈরির কাজ।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্রটি জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে সাবিরার মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে। তাতে বলা হয়েছে, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগে ওই চিকিৎসক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন কি-না, ফরেনসিক বিভাগে তা জানতে ভেজাইনা সোয়াব পরীক্ষা করতেও পাঠিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। তবে ফরেনসিক ল্যাবের ভিসেরা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের আগে নিপীড়ন বা ধর্ষণের কোনো আলামত মেলেনি।
সাবিরার লাশ উদ্ধারের পর তার শরীরের একটা অংশ দগ্ধ অবস্থায় পায় পুলিশ। তখন ধারণা করা হয়েছিল, হত্যার পর খুনিরা বিস্ম্ফোরক বা দাহ্য বস্তু দিয়ে চিকিৎসক সাবিরার লাশটি পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিস্ম্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডস্থলে বিস্ম্ফোরক বা দাহ্য পদার্থের অস্তিত্ব মেলেনি। তদন্ত সংশ্নিষ্টরা এখন ধারণা করছেন, খুনি বা খুনিরা হয়তো স্বাভাবিকভাবেই আগুন লাগিয়েছে বা অগ্নিকাণ্ডটি ছিল দুর্ঘটনা।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম গত বুধবার সমকালকে বলেন, তারা ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং বিস্ম্ফোরক প্রতিবেদন পেয়েছেন। এখন এসব প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে তাদের টিম তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা বলছেন, খুনের ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ফরেনসিক ও ল্যাবের পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। তদন্তের এ পর্যায়ে তারা অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠলেও এখনও হত্যাকাণ্ডের কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একটি হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য সব কারণ মাথায় রেখেই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সিআইডি সাবিরার জব্দ করা মোবাইল ফোনটিরও ফরেনসিক পরীক্ষা করেছে। এর প্রতিবেদনে তদন্তে কাজে আসবে, এমন কিছু মেলেনি।
চলতি বছরের ৩০ মে কলাবাগানের প্রথম লেন এলাকায় নিজ ফ্ল্যাট থেকে সাবিরার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গলা কাটা ছিল, পিঠেও ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাত। তোশকসহ তার দেহের অংশ ছিল আগুনে পোড়া। নিজের শয়নকক্ষে একজন চিকিৎসকের এমন পরিণতিতে তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ডা. সাবিরা রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন। সাবিরা ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। তার ছেলে থাকতেন নানির কাছে।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, সাবিরা যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেটিতে তিনটি কক্ষ রয়েছে। একটি কক্ষে সাবিরা, বাকি দুটি কক্ষে দুই তরুণী ভাড়া থাকতেন। পাশের কক্ষে থাকা কানিজ সুবর্ণা মডেলিং করেন। তিনি ওই দিন বাসাতেই ছিলেন। আরেকটি কক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে অধ্যয়নরত এক তরুণী থাকতেন। তিনি ওই সময় ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন।
সুবর্ণা ওই সময় দাবি করেছিলেন, ঘটনার দিন সকাল ৬টায় তিনি মর্নিংওয়াকে বের হন। তখন সাবিরার কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল। সকাল সাড়ে ৯টায় ফিরে এসে তিনি ওই কক্ষ থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন। ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভালে সাবিরাকে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
দীর্ঘ তদন্তেও থানা পুলিশ কিছু না পাওয়ার বিষয়ে ওই সময়ের তদন্ত সংশ্নিষ্ট কলাবাগান থানার এক কর্মকর্তা জানান, তারা সাবিরার মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই ছাড়াও অন্তত ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। কিন্তু রহস্য ভেদ করা যায়নি। ওই বাড়িতে কেউ এলে তা খাতায় লিখে রাখারও ব্যবস্থা ছিল না। সাবিরার লাশ ভেতরে থাকলেও দরজা ভাঙার আলামত ছিল না। বাড়িটির সামনে সিসি ক্যামেরা ছিল না। এসব কারণে তদন্ত নিয়ে তাদের অন্ধকারেই থাকতে হয়েছে।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,