কাজের বাইরেও প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব থাকে। প্রচলিত এসব আচার-আচরণ ওই ব্যক্তির মানসিকতাতেও প্রভাব ফেলে। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ কাজ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের দোলাচলে পড়েন। ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে পেশাগত জীবনকেন্দ্রিক।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ হোম অফিসে অভ্যস্ত হয়েছেন। ঘরে থেকে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই ঘরের সময় আর অফিসের সময়টা আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই কর্মজীবন আর ব্যক্তিজীবনের জায়গাটা আলাদা রাখা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের মনোবিজ্ঞান ও বিপণন বিষয়ের অধ্যাপক এবং ‘ব্রিং ইয়োর ব্রেন টু ওয়ার্ক’ বইয়ের লেখক আর্ট মার্কম্যান বলছেন, ‘প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে আমাদের নানা কর্মপরিকল্পনা থাকে। সেগুলো সব সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। যদি জীবনের সবকিছুই পেশাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তার অর্থ হলো পুরো জীবন রোলার কোস্টারের মতো হয়ে যাবে।’
কিসে সুফল মেলে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিজীবনকে আলাদা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রের সমস্যাগুলো ব্যক্তিজীবনকে যেন প্রভাবিত না করে, সে লাগাম ধরতে হবে নিজেকেই। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের পরিচয়টা আলাদা করতে পারব। পেশাগত জীবন ব্যক্তিত্বের একটা অংশ। পেশাগত জীবন কারও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন হতে পারে না।
‘আস্ক আ ম্যানেজার’ ব্লগের পরামর্শক ও প্রতিষ্ঠাতা অ্যালিসন গ্রিন বলেন, কেউ যদি তাঁর ব্যক্তিত্বকে পেশাগত পরিচয়ের সঙ্গে এক করে ফেলেন, তার অর্থ হলো তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রিত নয়। অ্যালিসন গ্রিন আরও বলেন, যদি কর্মক্ষেত্রে কাজ খারাপ হয়, তাহলে মানসিকতার ওপর তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু সেই মানসিকতা ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করলে বুঝতে হবে কারও সুখ বা দুঃখ তাঁর পরিবার ও সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। কর্মজীবনের ওপর নির্ভরশীল।
অ্যালিসন গ্রিন বলেন, জীবনযাপন চাকরিকেন্দ্রিক হয়ে পড়লে দৈনন্দিন জীবনে নিজস্বতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। দীর্ঘ সময় অফিসে কাজ করলে নিজের শখ, পরিবার ও বন্ধুদের সময় দেওয়া এবং আনন্দে সময় কাটানোর পরিমাণ কমে আসে। অফিসকেন্দ্রিক জীবন মানুষের ব্যক্তিত্বকেও বদলে দেয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই পারিবারিক জীবনে অন্যকে সময় দেওয়ার বিষয়টি তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে।
অধ্যাপক আর্ট মার্কম্যান বলছেন, কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবারকে সময় দিলে পেশাগত জীবনেও দক্ষতা বাড়ে। কারণ মানুষের মস্তিষ্কও একটানা কাজের মধ্যে আনন্দ ও অবসর চায়। এমনকি কারও যদি জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় পেশাগত জীবনে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো, তাহলেও তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে সময় দেওয়া প্রয়োজন। এর অর্থ এই নয় যে কর্মক্ষেত্র, পেশাগত জীবন বা সহকর্মীদের সময় দেওয়ার প্রয়োজন নেই অথবা তাঁদের কম গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সেটিকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য করে তোলা অর্থহীন।
লাগামটা কোথায় ধরবেন
অ্যালিসন গ্রিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রথম দিকে হোম অফিসের সময় অনেকেই কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে দ্বন্দ্বের কথা জানিয়েছেন। অফিসকে সময় দিতে গিয়ে ঘরকে সময় না দেওয়া অথবা ঘরকে সময় দিতে গিয়ে অফিসকে সময় না দিতে পারা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে অনেককে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, রাজধানীতে বেসরকারি চাকরিজীবী শাহানা আহমেদের কথা। হোম অফিসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ের পরেও শাহানাকে প্রায়ই জুম মিটিংয়ে অংশ নিতে হয়। যেহেতু তাঁর প্রতিষ্ঠানের সবাই হোম অফিস করছেন, তাই জুম মিটিংয়েরও কোনো সময়সীমা থাকে না। হয়তো রাত ১০টার সময়ই এমন মিটিং শুরু হলো। দুই মাস এভাবে হোম অফিস করার পর শাহানা বুঝতে পারেন তাঁর ব্যক্তিজীবন অফিসের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে। তাঁর সন্তান ও পরিবারকে তিনি সময় দিতে পারছেন না। ঘরের কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। কারণ, সময়ে–অসময়ে তাঁকে অফিসে যোগ দিতে হচ্ছে। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তিনি নিজের কোনো কাজ, অবসর, আনন্দ ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিষয়টির সমাধান অবশ্য শাহানা নিজেই বের করেছেন। কথা বলেছেন অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁকে তিনি বোঝাতে পেরেছেন অফিস আর বাসার নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। তাতে অফিসের কাজ আরও গুছিয়ে দায়িত্বের সঙ্গে করা যায়। পরিবারকেও সময় দেওয়া যায়। কর্মীর মানসিকতাও ভালো থাকে। শাহানার এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের পরে তাঁর প্রতিষ্ঠানে হোম অফিস চলাকালেও কাজের ও মিটিংয়ের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এতে উপকৃত হয়েছেন সব কর্মীই।
এ ধরনের সমস্যা মেটানোর উপায় বাতলে দিয়েছেন অ্যালিসন গ্রিনও। তিনি বলছেন, অফিসের জীবন ও নিজের জীবন আলাদা করার সীমারেখাটা নিজেকেই টানতে হবে। অফিসের কর্মঘণ্টার পরে ফোন ধরা বা ই–মেইল খোলার প্রয়োজন নেই। অনেক সময় কাজের মধ্যে হালকা বিরতি নেওয়াও জরুরি।
গ্রিন বলছেন, স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থাপকের সঙ্গে আলোচনাও করে নেওয়া যেতে পারে। ব্যবস্থাপককে বলা যেতে পারে, আপনি ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনকে আলাদা রাখতে চান। তবে সেটা কোনোভাবেই কর্মজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
পেশাগত জীবন ও ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে জীবনের প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেই হবে। সেই সঙ্গে পারিবারিক জীবন, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কের ভিতটাও শক্ত রাখতে হবে। সময় দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছুটির দিনগুলোয় অথবা ঘরে থাকার সময়টুকু ভালোভাবে কাটানোর ওপর জোর দেন তিনি। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব তাঁর পেশা, সম্পর্ক, দক্ষতা, অদক্ষতা—সবকিছু নিয়েই গড়ে ওঠে। যেকোনো একটিকে প্রাধান্য না দেওয়ার সহজ উপায় হলো ভারসাম্য বজায় রাখা।
এই মনোবিদ বলছেন, পারিবারিক বা বন্ধুদের আড্ডায় পেশাগত পরিচয় অনেক সময় প্রাধান্য পায়। সে বিষয়টাকেও সহজভাবে নিয়ে সাধারণ গল্পের ছলেই পরামর্শ দেওয়াটা যৌক্তিক। যেমন ধরা যাক, কেউ ভালো রান্না করেন। সেটা তাঁর একটা গুণ। যেকোনো আড্ডায় তাঁর কাছে হয়তো সেই রান্নার রেসিপি জানতে চাওয়া হয়। সেটাকেও আড্ডার একটা অংশ বলে ধরে নেওয়া যায়।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,