লেখক: মেহরীন নেওয়াজ।
‘কেমন আছ?’
উত্তরে শেষ কবে মন থেকে ‘ভালো’ বলেছেন? ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, সংসার, ক্যারিয়ার, সবকিছুর ভারসাম্য ঠিক রাখতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা। অবসাদগ্রস্ত হলে আমাদের মস্তিষ্ক একটু ফাঁকিবাজি করতে চায়। অর্থাৎ একদম হাতের নাগালে যেসব তথ্য আছে, সেগুলো ব্যবহার করেই অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ফলে চিন্তাভাবনা ছাড়া নিতান্তই অনুমানের ভিত্তিতে আমরা কাজ করতে থাকি।
বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা যায় ‘এক্সপেডিয়েন্সি বায়াস’ অর্থাৎ যা ভালো মনে হলো, তা-ই করে ফেলা। আমাদের মস্তিষ্ক এই চালাকি করে, কারণ নতুন ধারণাগুলো যাচাই–বাছাই করার চেয়ে পুরোনো ধারণা আবার ব্যবহার করাটাই সহজ। মনোবিজ্ঞানে এই নীতিকে বলে ‘ফ্লুয়েন্সি’ বা ‘সাবলীলতা’। এই নীতির কারণেই আপনি যদি ফরাসি ভাষা জানেন, তবে চীনা ভাষা শেখার চেয়ে আপনার জন্য স্প্যানিশ শেখা সহজ।
‘হেডোনিক প্রিন্সিপাল’ বলে ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে। এর অর্থ হলো—মানুষের যা ভালো লাগে, সেটিই সে বারবার করতে চায়। যা-ই ‘স্বাভাবিক’ মনে হবে, সে দিকেই আমরা ধাবিত হব। এই স্বাভাবিকের মানদণ্ড দিয়েই কেটে যায় আমাদের দৈনন্দিন জীবন। এই মানসিকতা আমাদের অস্তিত্বের এতটা ভেতরে গেঁথে গেছে যে কোনো নতুন পথে হাঁটতে গেলেই মনটা ঠিক সায় দেয় না। সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ (এইচবিআর) সাময়িকীতে।
নিবন্ধে বলা হয়েছে—ধরুন, আপনি হয়তো ভাবলেন, আজ থেকেই জোরেশোরে শরীরচর্চা শুরু করবেন। তুমুল উৎসাহটা প্রথমবার দৌড়াতে যাওয়ার পরই ক্ষীণ হয়ে যায়। শুরু হয় হাত-পায়ে ব্যথা, কিংবা দাম দিয়ে ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অনুশোচনা। মনে হতে পারে, এই সময়টা আরও কত মজাদার কাজ করেই না কাটানো যেত। তখনই মস্তিষ্ক আগের নিষ্ক্রিয় জীবনে ফিরে যাওয়ার সংকেত দিতে শুরু করবে।
তাহলে কীভাবে এই কঠিনকে সহজ করা যায়, যেখানে আমাদের নিজের মস্তিষ্কই আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে? এইচবিআরে সে কথাও বলা হয়েছে।
প্রথম সমাধান হলো—মেজাজ ভালো থাকলেই কঠিন কাজগুলোয় ঝাঁপিয়ে পড়ুন। ২০১৬ সালের একটা গবেষণায় দেখা যায়, মন খারাপ থাকলে মানুষ কঠিন কাজ করতে চায় না। কিন্তু মন ভালোর দিনগুলোতে কঠিন কাজকেও সহজ মনে হতে শুরু করে। জীবনের মান উন্নত করার জন্য আরেকটা কাজ করা যায়, যার নাম ‘পুনর্মূল্যায়ন’। নিজের মাথার মধ্যেই একটা কাজ সম্পর্কে ধারণাটা বদলে ফেলতে হবে। নিজেই যদি নিজেকে বলেন, ‘এই কাজটা করলে আমার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যাবে,’ দেখবেন আগে যতটা খারাপ লাগছিল, তেমনটা আর লাগবে না। আলস্যের গোলকধাঁধা থেকে মগজকে বের করে আনতে এটা হতে পারে কার্যকর উপায়।
দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্ককে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। যখনই সামনে একটা সিদ্ধান্ত আসে, আমাদের অজান্তেই মস্তিষ্ক সহজ পথটা বাছাই করে ফেলে। তখন নিজের সঙ্গেই নিজেকে একটা লড়াইয়ে নামতে হবে। হয়তো কঠিন কাজটা করার জন্য নিজেকে দিতে পারেন কোনো পুরস্কার। যেমন স্বাস্থ্যকর কিছু খাওয়া নিয়ে নিজের সঙ্গে বিতর্ক না করে ভাবতে পারেন, ‘আমি কি শাকসবজি খাব, যা আমাকে দীর্ঘক্ষণের জন্য শক্তি দেবে? নাকি রসগোল্লা খাব, যা খেলে আমার ঘুম পায় আর অলস লাগে?’ একই ধারণা যদি কাজের ক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তো বেশ হয়। কাজের ক্ষেত্রেও নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘আমি কি একটি কাজ করার জন্য নতুন কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করতে চাই, নাকি পুরোনো স্প্রেডশিট দিয়েই কাজ চালাব, যা নিয়ে অফিসের লোকেরা প্রায়ই অভিযোগ করে?’
কঠিন কাজ সহজ করতে আরেকটা কাজও করা যায়। তা হলো ‘বৃদ্ধির মানসিকতা’ (গ্রোথ মাইন্ডসেট) অনুশীলন। পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে যেতে গেলেই নিজেকে থামাতে হবে। এ বিষয়ে কাছের মানুষের কিছু অনুপ্রেরণা পাওয়া গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। সাফল্য নয়, চেষ্টা করার গল্পগুলোই মানুষকে বলুন, মনটা হালকা হবে। উদাহরণ হিসেবে একটা ঘটনা বলা যায়। একদল কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা সকালে কোনো সভা করবেন না। সকালবেলাটা বরাদ্দ থাকবে গভীর কাজের জন্য। অনেকের জন্য এই প্রক্রিয়াটা কাজে দিলেও অনেকে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারলেন না। ফলে এক মাস পর কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ঠিক এই পদ্ধতি নয়, অন্য কোনো পদ্ধতিতে এগোনো দরকার। শুধু সোমবার সকালটা মিটিংহীন রেখে বাকি সপ্তাহটা আগের নিয়মে চলল। এ থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়, নতুন অভ্যাস গড়ার চেষ্টা সব সময় সফল না হলেও তা থেকে কোনো না কোনো সুফল আসতেই পারে। পুরোনো তরিকায় ফিরে যাওয়ার চেয়ে, কিছুটা নতুন আর উন্নত উদ্যমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কঠিন কাজ যা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে, প্রায়ই নিজের মনের বিরোধী হয়। কিন্তু নিজের মগজে কী চলছে, তা বুঝতে পারলে কঠিন কাজগুলোই সহজ হয়ে যাবে আর ভয়গুলোকে করা যাবে জয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,