লেখক: শাকিলা হক।
চলতি মাসে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো ‘প্যান্ডোরা পেপারস’ ফাঁসের ঘটনা। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া এসব তথ্যের মধ্যে আছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গোপন অর্থ লেনদেনের কথা। করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত পানামা, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো দেশ ও অঞ্চলের কোম্পানিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কত অর্থ রেখেছেন ও কত লেনদেন করেছেন, সেই সব গোপন তথ্য আর গোপন নেই প্যান্ডোরা পেপারসের কারণে।
একেকটা প্রকাশিত নথি যেন একেকটা বোমা ফাটিয়েছে। যেমন জর্ডানের বাদশাহ গোপনে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে ১০ কোটি ডলারের সম্পদ করেছেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তাঁর স্ত্রী লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মোনাকোয় রয়েছে গোপন সম্পদ—এমন সব তথ্য। বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) উদ্যোগে ৬৫০ জনের বেশি সাংবাদিক এসব নথি বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করেছেন। বিবিসি বলছে, এসব নথিতে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস ও লুক্সেমবার্গ লিকস নামে নয় বছর ধরে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী ও সম্পদশালী ব্যক্তিদের অন্য দেশে বেনামে বিনিয়োগের তথ্য ফাঁসের যে ধারাবাহিকতা চলে আসছে, সেখানে সর্বশেষ যোগ হলো প্যান্ডোরা পেপারস। গার্ডিয়ান বলছে, ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বেশি তথ্য ফাঁস হয়েছে। তবে এটির নাম কেন প্যান্ডোরা? প্যান্ডোরা নামের পরিচিতিই–বা কী! অনেকেই হয়তো জানেন, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রথম মানবী হলেন প্যান্ডোরা। প্যান্ডোরা হলেন প্রথম মরণশীল নারী। তবে বিশ্বে প্যান্ডোরার চেয়ে বেশি পরিচিত ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ শব্দগুচ্ছ। ইংরেজি ভাষায় প্রায়ই একটি লাইন ব্যবহার করতে দেখা যায়, ‘ওপেনস আ প্যান্ডোরাস বক্স’। এই প্রবাদ ও প্রবচনের মানে হলো, এমন আকস্মিক কিছুর প্রকাশ, যা অনেক নতুন সমস্যা তৈরি করবে, যা একেবারেই কেউ আশা করেনি। গ্রিক পুরাণে প্যান্ডোরার বাক্সের গল্পটাও কিন্তু ঠিক তেমন। এখানেও প্যান্ডোরা বাক্স খোলার মানে হলো, এমন একটি প্রক্রিয়া যা একবার শুরু হলে অনেক জটিল সমস্যা তৈরি করে। দুঃখ ও কষ্টের ভান্ডার যেন এই বাক্স। এবারে বলা যাক, সেই প্যান্ডোরার বাক্সের গল্প।
এই মিথের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রিক লেখক হেসিওদের লেখা থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৭০০ বছর আগে লেখা হয় সেটি। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীতে একসময় কেবল পুরুষ বাস করত। অলিম্পিয়ান দেবতা প্রমিথিউস ভাস্বর হয়ে আছেন মানবকল্যাণের জন্য। এমনকি দেবতাদের চেয়ে মানুষের প্রতি তাঁর মমতা প্রকাশ পেত বেশি। তবে এর জন্য তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন আরেক দেবতা জিউস। একসময় জিউস মর্ত্যে নারী সৃষ্টি করতে চাইলেন। এর পেছনে গভীর কারণ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, প্রমিথিউসের ওপর প্রতিশোধ নেবেন। কারণ, বিভিন্ন সময় দেবতাদের বৈঠকে মানুষের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে জিউসকে অপমান করতেন প্রমিথিউস। গ্রিক পুরাণের কারিগরের দেবতা হেফাস্টাস। তাঁকে নিয়ে কাদামাটি থেকে তৈরি করলেন অপূর্ব মানবী। প্যান্ডোরা নাম দিয়ে তাতে প্রাণ সঞ্চার করলেন। গ্রিক ভাষায় ‘প্যান্ডোরার’ অর্থ হলো ‘সবার উপহার’। দেবতা জিউসের এই অসাধারণ সুন্দরী ও কোমল মেয়েকে দেখে সবাই মুগ্ধ হন। জিউস চাইলেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রমিথিউসের এক ভাই এপিমিথিউসের সঙ্গে প্যান্ডোরার বিয়ে দিতে। এপিমিথিউস জিউসের কোনো উদ্দেশ্য আছে বুঝতে পারলেও প্রথম দেখাতেই অপূর্ব সুন্দর প্যান্ডোরার প্রেমে পড়ে যান। আর তাই সম্মতি দেন। প্রচণ্ড জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় প্যান্ডোরা ও এপিমিথিউসের। সবার উপহার দিয়ে অপূর্ব সাজে সাজেন প্যান্ডোরা। প্রবেশ করেন এপিমিথিউসের গৃহে।
বিয়েতে জিউসের থেকে কোনো উপহার নেননি এপিমিথিউস। তাই প্যান্ডোরাকে উপহার দেন জিউস। সেটি ছিল একটি অদ্ভুত বাক্স। অদ্ভুত এ কারণে যে এতে লেখা ছিল, ‘কখনো খুলবে না’। এই নির্দেশনা লেখা থাকলেও এর সঙ্গে একটি চাবি দেওয়া হয় খোলার জন্য। আর মানবজাতির পুরোনো প্রবৃত্তিই যে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, তা তো সবারই জানা। যা নিষেধ করা হয়, কেন তা নিষেধ করা হলো তা জানার এক অদম্য কৌতূহল মানুষের। আর সেই কৌতূহলের বশেই সেই বাক্স একদিন খুলে ফেলেন প্যান্ডোরা। বাক্সটি থেকে হুড়মুড় করে বের হতে থাকে অশুভ সব শক্তি। ঈর্ষা-ব্যাধি-ঘৃণা-জরা-শোক। প্যান্ডোরা দ্রুত ডালাটি বন্ধ করে ফেললেও ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। অশুভ আর খারাপ শক্তিগুলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে, মর্ত্যের মানুষের দেহে, মনে। এ সময় এপিমিথিউস ঘরে আসেন। দেখেন প্যান্ডোরা কাঁদছেন। প্যান্ডোরা
এপিমিথিউসকে কী ঘটেছে দেখানোর জন্য আবার বাক্সটি খোলেন। তখন বাক্স থেকে বের হয় শেষ শক্তি, ‘আশা’। বাকিগুলো তো আগেই চলে গেছে। এটাই হলো প্যান্ডোরার গল্প। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী মানুষের জীবনের সব রোগ, শোক, তাপ এসেছে এই প্যান্ডোরার বাক্স থেকে। অথচ এটি খুলতে নিষেধ করা হয়েছিল।
আবার আসি বর্তমানের প্যান্ডোরা পেপারস ফাঁসের ঘটনায়। প্যান্ডোরা পেপারসে ৩৩০টির বেশি রাজনীতিক এবং ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যার মধ্যে ৩৫ বর্তমান এবং সাবেক সরকার প্রধান রয়েছেন। অনেক সম্পদশালী ব্যক্তির তাঁদের সম্পদের গোপনীয়তা রক্ষা করার বৈধ কারণ থাকতে পারে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ফাঁসের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে সিস্টেমের অপব্যবহার হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এখন এই তথ্য উন্মোচনের ফলে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্বে ধনী-দরিদ্র বিভাজনের তীব্রতার পটভূমিতে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো। মহামারির কারণে ধনী–দরিদ্রের এই বিভাজন বেড়েছে। অনেক দেশের মধ্যেই ধনী বিশেষাধিকার সম্পর্কে মানসিক অসন্তোষ বেড়েছে। এ ধরনের তথ্য মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে অবিশ্বাস তৈরি করে। যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম এসেছে প্যান্ডোরা পেপারসে। তবে পুতিনের মুখপাত্র এই গবেষণাকে অস্পষ্ট বলেছেন। জর্ডানের বাদশাহর গোপন সম্পদ গড়ার কথা এসেছে। এদিকে তার মুখপাত্র বলছেন, এগুলো বাদশাহর ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে কেনা।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মার্কিন কার্যালয়ের পরিচালক গ্যারি কালম্যান মনে করেন, এসব তথ্য হয়তো রাজনৈতিক নেতৃত্ব উৎখাতে ভূমিকা রাখবে না, তবে পুতিন জর্ডানের বাদশাহর মতো নেতাদের সুনাম নষ্টের ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকাই রাখবে। যেমন জর্ডানবাসীরা এখন জানে, মালাবু ও জর্জটাউনে সম্পত্তির জন্য অর্থ ব্যয় করেছেন বাদশাহ। কিন্তু জর্ডানের মানুষের মৌলিক সেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তাঁর হাতে নেই। আবার যারা দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার চালিয়েছিলেন—যেমন পাকিস্তান, চেক প্রজাতন্ত্র এবং কেনিয়ার সরকারেরা—প্যান্ডোরা রিপোর্টে তাদের জন্য অন্তত বিব্রতকর।
তাই বলা যায়, প্যান্ডোরার বাক্স যেমন রোগ–শোকের এক উল্লম্ফন সৃষ্টি করেছিল মর্ত্যে। তেমনি নতুন প্যান্ডোরা পেপারস রাজনৈতিক বোমা ফাটিয়েছে বিশ্বে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ অক্টোবর ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,