বাংলাদেশি ভোটাররা আগামী রোববার এমন একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন যার ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। বিরোধী দলের বয়কটের কারণে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হতে চলেছেন। শেখ হাসিনার এই বিজয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য একটি পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে স্থান দিয়েছেন গণতন্ত্রকে এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি উদাহরণ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবথেকে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা নারী সরকার প্রধান। তিনি একটি আকর্ষণীয় প্যারাডক্স তৈরি করেছেন। তিনি কট্টরপন্থী ইসলাম দমন করেছেন, সেনাবাহিনীর উপর বেসামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করেছেন এবং তার দেশকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন। এগুলো এমন সব অর্জন যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের নেতারাই দাবি করতে পারবেন না। আবার একইসঙ্গে তিনি এমন রাজনীতির দিকে হাঁটছেন যাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের চেয়ে ‘গেম অফ থ্রোনস’ বললেই বেশি মানানসই হয়। যারাই মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, তারাই আইনি হয়রানি ও সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের প্রশাসনের পার্থক্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন বাইডেন। এর অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণগ্রেফতারের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলিকে ভয় দেখানোর জন্য শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছে হোয়াইট হাউস।
কিন্তু শেখ হাসিনা বিরোধী দল বা সুশীল সমাজের জন্য আরও উদার হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি হোয়াইট হাউসের প্রচেষ্টাগুলোকে পাত্তা দেন না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রায় ১০ হাজার কর্মী ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতির বিশেষজ্ঞ অবিনাশ পালিওয়াল বলেছেন, এটি অত্যন্ত কঠিন এক শক্তি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো আভাসও নেই।
তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ ছিল বাইডেনের এই মূল্যবোধ-কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি আদর্শ পরীক্ষার ক্ষেত্র। কিন্তু এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক জনবহুল দেশটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারপরেও ওয়াশিংটন নিজের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে গণতন্ত্র প্রচারের ঊর্ধ্বে রাখেনি।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ একটি একদলীয় শাসনের দিকে ধাবিত হয়েছে। তবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের গভীর গণতান্ত্রিক শিকড় রয়েছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ভারতের অংশ ছিল বাংলাদেশ। ফলে দেশটি নির্বাচন ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং মুক্ত সংবাদপত্রের মতো উদারপন্থী চর্চার সঙ্গে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের অনেক নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা দেশগুলোতে পড়াশুনা করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানির উপর বাংলাদেশের অর্থনীতি নির্ভর করছে। ২০২২ সালে তাদের কাছে ৩২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বিক্রি করেছে বাংলাদেশ। এ কারণে বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ওয়াশিংটন। কিন্তু হোয়াইট হাউস এই সুযোগটি নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি হাই-প্রোফাইল ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি’ থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের থেকেও খারাপ রেকর্ডের বেশ কয়েকটি দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’ নামের একটি সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা দানকারীদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করে।
হোয়াইট হাউসের বুঝা উচিত ছিল যে, এমন কড়া কথা এবং আধাআধি পদক্ষেপ বাংলাদেশের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ, যার কৃতিত্ব দাবি করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা দক্ষতার সঙ্গে মার্কিন চাপের মোকাবিলা করেছেন। এ জন্য তিনি রাশিয়া, চীন এবং ভারতকে নিয়ে ‘অসম্ভব’ একটি ঐক্য তৈরি করেছেন। ভারত বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপকে বিপজ্জনক মনে করে। দেশটি চায়, যুক্তরাষ্ট্র যাতে বাংলাদেশে চীনা প্রভাব মোকাবিলায় দিল্লির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
ভারত মনে করে, শেখ হাসিনার দুর্বলতা যতই থাকুক না কেন তার বিকল্প হবে আরও খারাপ। শেষবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে নীরব ছিল দলটি। পাশাপাশি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটবদ্ধ। এই দলটি বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অকথ্য নৃশংসতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভারত তাই আর বিএনপি সরকারকে আরেকবার সুযোগ দিতে রাজি নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে যে- বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করা প্রয়োজন। ভারতকে বুঝাতে না পেরে শেখ হাসিনাকে সতর্ক করার ওপরই নির্ভর করছিল হোয়াইট হাউস। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন যে প্রায়ই তার লক্ষ্যের তুলনায় সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি এটি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, জটিল এই বিশ্বে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা যত সহজ, সফলভাবে তা বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন।
সূ্ত্র:মানবজমিন।
তারিখ: জানুয়ারী ০৫, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,