লেখক:প্রতীক বর্ধন।
দেশের আনাচকানাচে দেখা যায়, দোকানে দোকানে চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট ঝুলছে, নানা রকমের চকলেট থরে থরে সাজানো, ফ্রিজে শোভা পাচ্ছে কোমলপানীয়র বোতল আর আইসক্রিমের বাটি। এ ছাড়া গ্রামের বাজারেও আজকাল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল, স্মার্টফোন ও টিভি-ফ্রিজসহ ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ যে জীবনধারা এক সময় পশ্চিমা সিনেমায় দেখা যেত, দেশের মানুষের একটি অংশ এখন সেই জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
একটি বিষয় পরিষ্কার, দেশে একশ্রেণির ভোক্তা তৈরি হয়েছে, যাঁরা এখন বিলাসী পণ্য ও দামি সেবা কিনতে পারেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার জোরদারে এই ভোক্তাশ্রেণির ভূমিকাই প্রধান।
২০২০ সালে বিশ্বের মোট ভোক্তাশ্রেণির মানুষের মধ্যে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ সাড়ে তিন কোটি মানুষের বসবাস ছিল বাংলাদেশে। এই হার ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে দ্বিগুণ তথা ১ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হবে। অর্থাৎ তখন দেশে ভোক্তাশ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৮ কোটি।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হচ্ছে এশিয়া। এই তালিকায় সম্ভাবনাময় দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণির বিকাশ হবে সবচেয়ে বেশি।
তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট ভোক্তাশ্রেণির মানুষের মধ্যে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ সাড়ে তিন কোটি মানুষের বসবাস ছিল বাংলাদেশে। এই হার ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে দ্বিগুণ তথা ১ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হবে। অর্থাৎ তখন দেশে ভোক্তাশ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৮ কোটি। এই এক দশকে দেশে ভোক্তাশ্রেণিতে যুক্ত হবে আরও পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। সেই সুবাদে বৈশ্বিক ভোক্তাশ্রেণির তালিকায় বাংলাদেশ ১৭ ধাপ এগিয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ায় ভোক্তাশ্রেণির বিকাশে বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি উন্নতি হবে ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের। তারা যথাক্রমে আট ও সাত ধাপ এগোবে। তবে ভোক্তাশ্রেণির শীর্ষ তিনে থাকা চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু সংখ্যার বিচারে ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভোক্তাশ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্ত হবে ভারতে। এ সময়ে দেশটির প্রায় ৪২ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত ভোক্তাশ্রেণির কাতারে উঠবে। একই সঙ্গে চীনে যুক্ত হবে প্রায় ৩৪ কোটি মানুষ। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে এই কাতারে উঠবে ২ কোটি ৪২ লাখ মানুষ।
শিল্পায়ন যেন নিছক আমদানি প্রতিস্থাপক না হয়। অর্থাৎ এই শিল্পের কেবল দেশীয় চাহিদা পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা চলবে না, একই সঙ্গে তাদের বিদেশি বাজারের জন্যও উৎপাদন করতে হবে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
চলুন, এবারে আমরা জেনে নিই ভোক্তাশ্রেণি বলতে কী বোঝায়। যাঁরা এমন পরিবারে বসবাস করেন, যে পরিবারের দিনে অন্তত ১১ ডলার ব্যয় করার সামর্থ্য আছে, তাদের বৈশ্বিক ভোক্তাশ্রেণির মানুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। আর যাঁরা ১১ ডলার থেকে ১১০ ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে পারেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি ও বিলাসী পণ্য এবং সেবার জন্য যাঁরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম, তাঁরাই পড়েন ভোক্তাশ্রেণিতে।
ভোক্তাশ্রেণির এই উত্থানের সম্ভাবনা দেশের শিল্পপতিদের জন্য বড় সুযোগ নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তবে তিনি বলেন, শিল্পায়ন যেন নিছক আমদানি প্রতিস্থাপক না হয়। অর্থাৎ এই শিল্পের কেবল দেশীয় চাহিদা পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা চলবে না, একই সঙ্গে তাদের বিদেশি বাজারের জন্যও উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে ক্রেতারা পণ্যমূল্য ও গুণগত মানের দিক থেকে ঠকবেন বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, নতুন এই ভোক্তাদের চাহিদা চিরকাল একরকম থাকবে না। এখন বিশ্বায়নের যুগ। টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা দেখবেন, উন্নত দেশের মানুষেরা কত বিচিত্র ধরনের পণ্য ব্যবহার করেন। তাঁদের সামর্থ্য যখন বাড়বে, তখন তাঁরাও উন্নত মানের পণ্য ভোগ করতে চাইবেন। কিন্তু দেশের শিল্পপতিরা কেবল স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদন করলে এই চাহিদা পূরণ করতে পারবেন না। সে জন্য দেশের বাণিজ্যনীতিতে ভারসাম্য আনার পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান, যাতে উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যও পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী হন।
একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অভ্যন্তরীণ ভোগের হারই সবচেয়ে বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে অভ্যন্তরীণ ভোগের (সরকারি ও বেসরকারি) হার ছিল ৬৯ দশমিক ১১ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি অর্থাৎ ব্যক্তি খাতের ভোগের পরিমাণই বেশি। মাথাপিছু আয় বাড়লে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভোগব্যয়ও বাড়ে। আর তার ওপর ভর করেই এগিয়ে চলে অর্থনীতি।
ভোক্তাশ্রেণি ও মধ্যবিত্তের ভূমিকা
বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ প্রক্রিয়ায় মধ্যবিত্ত ভোক্তাশ্রেণির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা যত বাড়বে, ততই জীবনমান উন্নত হবে, দেশের প্রবৃদ্ধির হারও বাড়বে। কিন্তু করোনার কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের মধ্যবিত্তও বিপাকে পড়েছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন তাঁদের হাঁসফাঁসের কারণ। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো হয়েছে। অথচ কোভিডের প্রভাব মোকাবিলায় যত প্রণোদনা দেওয়া হলো, তার সবই গেল শিল্পপতিদের পকেটে। মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্র শ্রেণির মানুষ করোনার কারণে ইতিমধ্যে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য অংশ এমনিতেই সংকটে আছে, তার সঙ্গে বাজার যদি দীর্ঘ মেয়াদে অস্থিতিশীল থাকে, তার পরিণতি ভালো হবে না বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,