এ পি জে কালাম – অনেক কথার বাড়ি – ২( সংগ্রহিত)
‘মানুষের জোরজবরদস্তি পৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে দূষণের মতো হুমকি বলে মনে হচ্ছে।’ মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে এমন মন্তব্য করেন ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম। ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁরই সহকারী সৃজন পাল সিং।
ছয় বছর ধরে সহকারীর দায়িত্ব পালনকারী সৃজন তাঁর ওই স্ট্যাটাসে কালামের শেষ দিনের একটি দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছে এনডিটিভি অনলাইন। সেখানে সৃজন লিখেছেন:
কালাম স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দিনের স্মৃতির জন্যই আমাকে স্মরণ করবে সবাই। ২৭ জুলাই দুপুর ১২টায় আমরা বিমানের গুয়াহাটির ফ্লাইটে গিয়ে বসি। ড. কালাম ছিলেন “ওয়ান এ” সিটে, আমি ছিলাম “ওয়ান সি” সিটে। তিনি পরেছিলেন কালো রঙের “কালাম স্যুট”। আমি প্রশংসা করলাম, “সুন্দর রং! ” আমি তখনো জানতাম না যে আমার জন্য এটিই হবে তাঁর পরনে থাকা কোনো পোশাকের শেষ রং দর্শন।
বর্ষার মধ্যেই আমরা আড়াই ঘণ্টা বিমানে উড়ে গেলাম। উড়ন্ত অবস্থায় বিমানের ঝাঁকুনিটাকে আমি খুব অপছন্দ করি, তিনি এসব আমলে নিতেন না। যখন তিনি দেখতেন যে আমি ভয়ে জমে যাচ্ছি, তিনি বিমানের জানলার পর্দাটা নামিয়ে দিয়ে বলতেন, “এখন আর ভয়ের কিছু দেখতে পাবে না।”
শিলংয়ের আইআইএমে পৌঁছাতে আমাদের আরও আড়াই ঘণ্টা গাড়িতে করে যেতে হয়। এই পাঁচ ঘণ্টার যাত্রায় আমরা কথা বলেছি, আলোচনা করেছি। বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমতও হয়েছে। এ সময় পাঞ্জাবে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ড. কালাম উদ্বেগ দেখান। নিরীহ লোকজনের মৃত্যুতে তিনি খুব বিমর্ষ ছিলেন। আইআইএমে বক্তৃতার বিষয় ছিল “বাসযোগ্য গ্রহ পৃথিবী”। তিনি পাঞ্জাবের ঘটনাটিকে এই বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বললেন, “মানুষের জোরজবরদস্তি পৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে দূষণের মতো হুমকি বলে মনে হচ্ছে।” এ ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দূষণ ও মানুষের বেপরোয়া কাজকর্ম চলতে থাকলে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
ড. কালাম আমাদের পার্লামেন্ট নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ সংস্থাটি আর ঠিকমতো কাজ করছে না বলে তাঁর এই উদ্বেগ। তিনি বলেন, “আমার মেয়াদকালে আমি দুটি ভিন্ন সরকার দেখেছি। এর পরও আমি অনেক দেখেছি। এমন বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। এটি ঠিক নয়। পার্লামেন্টে উন্নয়নের রাজনীতি নিশ্চিত করার পথ বের করতে কিছু একটা করার প্রয়োজন বোধ করছি।” তারপর স্যার আমাকে অবাক করা একটি কাজ দিলেন। তা হচ্ছে, আইআইএমের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করা। এটি তিনি বক্তৃতার শেষে শিক্ষার্থীদের দেবেন। প্রশ্নটাতে তিনি শিক্ষার্থীদের তিনটি পরিকল্পনা বা পদ্ধতি দিতে বলবেন, যাতে আমাদের পার্লামেন্টের কাজের গতি আরও বাড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, “কিন্তু আমি তাদের কীভাবে পরিকল্পনা দিতে বলব, যেখানে আমি নিজেই এর কোনো সমাধান জানি না।”
ছয় থেকে সাতটি গাড়ির একটি বহরে আমরা ছিলাম। ড. কালাম এবং আমি ছিলাম দ্বিতীয় গাড়িতে। আমাদের সামনে একটি খোলা গাড়িতে তিনজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজন এক পাশে বসে ছিলেন এবং একজন তাঁর অস্ত্রটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গাড়ি ঘণ্টাখানেক চলার পর তিনি বললেন, “কেন সে দাঁড়িয়ে আছে? সে তো ক্লান্ত হয়ে যাবে। এটা তো একটি শাস্তির মতো। তুমি কি ওয়ারলেসে একটি বার্তা পারবে যাতে সে বসে যায়?” আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, সম্ভবত নিরাপত্তাজনিত কারণে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়ম। তিনি মানলেন না। আমরা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেটা কাজ করল না।
পরবর্তী দেড় ঘণ্টার যাত্রায় কালাম স্যার আমাকে তিনবারের মতো বললেন আমি যাতে হাতের ইশারার মাধ্যমে হলেও ওই নিরাপত্তাকর্মীকে বসতে বলি। অবশেষে তিনি যখন বুঝতে পারলেন, আমাদের আসলে তেমন কিছুই করার নেই। তিনি বললেন, “আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই এবং তাঁকে ধন্যবাদ দিতে চাই।” পরে আমরা যখন শিলংয়ে পৌঁছালাম, আমি নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকদের মাধ্যমে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কর্মীটিকে খুঁজে বের করলাম। আমি তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেলে ড. কালাম তাঁকে স্বাগত জানালেন। তিনি তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন এবং বললেন, “ধন্যবাদ, বন্ধু!” এরপর তিনি বললেন, “তুমি কি ক্লান্ত? তুমি কিছু খেতে চাও? তোমাকে আমার কারণে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো, আমি দুঃখিত।” সাবেক রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মী অবাক হয়ে গেলেন। তিনি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, শুধু বললেন, “স্যার, আপনার জন্য তো ছয় ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকা যায়।”
এরপর আমরা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে গেলাম। কালাম স্যার বক্তৃতার জন্য দেরি করতে চাইলেন না। “শিক্ষার্থীদের কখনোই অপেক্ষায় রাখা উচিত না”—তিনি সব সময় বলতেন। আমি তাড়াতাড়ি তাঁর মাইক্রোফোনটি ঠিক করে দিলাম। আমি যখন সেটি তাঁর কোটের সঙ্গে লাগিয়ে দিচ্ছিলাম, তিনি হেসে বললেন, “ফানি গাই! ঠিক আছে তো?” স্যার যখন “ফানি গাই” বলেন, এর অনেক রকমের অর্থ হতে পারে। কী অর্থ হবে সেটা নির্ভর করে তাঁর বলার ভঙ্গি এবং সেটা থেকে আমি আসলে কী বুঝলাম। এটার মানে হতে পারে—তুমি ভালো করছ, তুমি কিছু গোলমাল করে ফেলেছ, তুমি খুবই সাধাসিধে বা উৎফুল্ল থাকলে শুধু শুধু বলা। তিনি এদিন অনেক বেশি উৎফুল্ল ছিলেন। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গে থাকার ফলে ‘ফানি গাই’-এর অর্থ কী হতে পারে, সেটা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারি। এবারেরটা ছিল শেষবারের মতো।
এটা স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা। এর পর স্যার দুই মিনিটের মতো বক্তৃতা দিলেন। আমি তাঁর পেছনে বসে শুনছিলাম। একটি বাক্য বলার পর দীর্ঘ এক বিরতি লক্ষ করলাম। আমি তাঁর দিকে তাকালাম, দেখলাম তিনি পড়ে গেলেন। আমরা তাঁকে তুলে নিলাম। আমি তাঁর প্রায় বন্ধ চোখের সেই চাহনিটা ভুলতে পারব না। আমি এক হাতে তাঁর মাথাটাকে তুলে ধরে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার, সেই চেষ্টা করলাম। তিনি হাত দিয়ে আমার আঙুল ধরে রেখেছিলেন। চেহারায় ছিল শান্ত ভাব এবং নির্লিপ্ত চোখ থেকে প্রজ্ঞার আলো বের হচ্ছিল। তিনি একটি শব্দও বললেন না। ব্যথার কোনো চিহ্নও ছিল না।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা কাছাকাছি হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। আর কয়েক মিনিট পরেই তারা জানালেন, মিসাইলম্যান চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি শেষবারের মতো তাঁর পা ছুলাম। পুরোনো বন্ধু ও শ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতাকে বিদায় জানালাম! তাঁর চিন্তা-ভাবনাগুলো নিজের মধ্যে নিয়ে বাঁচব। পরের জন্মে দেখা হবে।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: জুলাই ১৭, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,