পাওলো কোয়েলহো এর এলেভেন মিনিটস
অনুবাদে: ইললু।
চতুর্থ অংশ
মারিয়া ঠিক করলো সে হবে জীবন অভিযানের নতুন এক নাবিক,হবে রাতের কান্না দুঃখ সরানো এক নতুন মারিয়া,তার নতুন জন্ম এক।অনুভুতির ঝড় একপাশে সরিয়ে তাকে হতে হবে নতুন এক মারিয়া ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার জন্যে।তার চারপাশটা ব্রাজিলের সেই ছোট্ট শহরটার মতই,মেয়েরা পর্তুগীজে কথাও বলতে পারে,একগাদা অভিযোগ পুরুষদের নিয়ে,একই ভাবে চীৎকার করে কথা বলে,কাজ নিয়ে বরাবরই অভিযোগ,ক্লাবে সময়মত পৌঁছায় না।সবাই ভাবে সেই সবচেয়ে সুন্দরী,সকলের আছে স্বপ্নের রাজকুমারের গল্প,যারা হয় বিবাহিত না হয় কর্পদকশুন্য,চলে তাদের আয়ের পয়সায়।এটা রজারের দেখানো কাগজপত্রের স্বপ্নের দেশের একেবারেই উল্টোটা।ক্লাবটা ভিভিয়ানের বর্ননার সাথে একেবারেই মিলে যায়,একটা পারিবারিক আবহাওয়া চারপাশটায়।প্রতেকটা মেয়ের কাজের অনুমোদন পত্রে লেখা, “সামবা নর্তকী”-কোন অতিথির আমন্ত্রনে তাদের বাইরে যাওয়ার নিয়মটা নেই।কারও কাছ থেকে কোন চিরকূট বা টেলিফোন নাম্বার নিলে অন্ততঃ বেতন ছাড়া দু সপ্তাহের কাজ থেকে বিরতি।মারিয়া ভেবেছিল যাচ্ছে উত্তেজনার কোন একটা পরিস্থিতিতে,কিন্ত ব্যাপারটা আদৌ তা নয়,মন ভাঙ্গা একাকীত্বের পৃথিবী একটা।
প্রথম দু সপ্তাহ শুধু কাজে যাওয়া আর হোটেল।মারিয়া আবিষ্কার করলো কেউ জানে না তার ভাষায় কথা বলতে,খুব ধীরে ধরে ধরে কথাগুলো বললেও।এটাও জানলো মারিয়ার সে দেশটার আরেকটা নাম কাছে সেটা “জেনেভা” যদিও ব্রাজিলের লোকজনের কাছে “জেনেভ্রা”।
কাজের শেষে লম্বা দিনগুলো মারিয়া কাটায় টিভি ছাড়া হোটেলের ছোট্ট ঘরটায়।
১)কোন দিনই পূর্ন হবে না মারিয়ার মনের ইচ্ছা যতদিন শেখা হবে না সেখান কার ভাষাটা।
২)তার কাজের সব নর্তকীরাই চায় সেই স্বপ্নের দেশ,তাই মারিয়ার দরকার অন্য উদ্দেশ্য,যার সমাধানটাও আছে তার কাছে।
এটা মারিয়ার ডাইরী থেকে নেয়া,জেনেভা/জেনেভ্রা আসার চতুর্থ সপ্তাহেঃ
“আমি যে অনন্তকাল ধরে পড়ে আছি এখানে,জানিনা এখানকার ভাষা,সারাটা দিন আমার কাটে রেডিওর গান আর ঘুরে বেড়ানো ঘরটার চারপাশটায়।যখন কাজ করি শুধু ভাবি কখন ফিরে যাব হোটেলের ঘরটায়,বেচে আছি শুধু আমি শুধু ভবিষৎ এর আশায়।সামনের দিনগুলোয় জানিনা কবে আসবে সেটা,প্লেনের টিকিট কেটে ফিরে যাব আমার,
ব্রাজিলে।এখন যদি বিয়ে করি কাপড়ের দোকানের মালিকটাকে,সবাই বলবে নানান ধরনের কথা,সেটা আমি হতে দিতে রাজী নয়,তার চেয়ে নিজেকে প্লেন থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই ভাল,যদি ও জানি প্লেনের জানালাগুলোতো খোলা যায় না।এখানেই বরং মরে যাওয়াটা ভাল।না আমি যুদ্ধ করে যাব নিজের মত,যা করবো আমি নিজের মত”।
০০০০০০০
মারিয়া ভর্তি হলো ফরাসী ভাষা শেখার ক্লাসে,সকালের দিকে ক্লাস।নানান ধরণের লোকের সাথে দেখা হয় সেখানে,বয়স,ধর্ম,পোষাকে আষাকেও নানান ধরণের। নানান ধরণের অলঙ্কার পরে থাকা মেয়েরা,রং এর বাহারের স্কার্ফ।শেখায় কমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সব কিছুই ছিল সহজ-উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল যদিও,অভিজ্ঞতা জীবন দর্শন মিলিয়ে বয়সের লোকজনের কাছে সেটা সহজ হওয়া উচিত।
মারিয়ার গর্বের শেষ ছিল না-ব্রাজিল কারো কাছেই অজানা নয়।সবার জানা “সামবা” নাচ,ব্রাজিলের কার্নিভাল,ফুটবলের কথা,আর পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাক্তি, “পেলে”।
মারিয়া মাঝে তাদের উচ্চারন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করতো,যখন দেখলো তাকেই তারা “মারিফ” বলে ডাকছে,তার ক্ষান্ত দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না,কোন।এটাও দেখলো সে ঐ বিদেশীদের কোন কিছু বলে লাভ নাই,তাদের সব সময়ই একটা ধারণা যে যাই হউক না কেন তারাই ঠিক।
নতুন শেখা ভাষা অভ্যাস করার জন্যে মারিয়া বিকেলের দিকটা কাটাতো শহরটার বিভিন্ন এলাকায়।চকলেট খেল মারিয়া নানান ধরণের,অদ্ভুত সুস্বাদু এক পনীর, দেখলো লেকের মাঝে “ঝর্না”,অবিশ্বাস্য ব্যাপার এক(কোন সন্দেহ নেই ব্রাজিলের কেউ দেখে নি কোনদিন)।রেস্তোরা যেখানে ভেতরে আগুন জলছে,যদিও তার সেই রেস্তোরাগুলোয় সুযোগ হয়নি কোনদিন।দেখলো বেশির ভাগ দোকানেই ঘড়ি লাগানো বাইরের দিকে,এমন কি ব্যাংকগুলোতেও।
বুঝে উঠতে পারেনি সে,মাত্র এই কজন লোকের জন্যে এতগুলো ঘড়ির কি দরকার?কাকে জিজ্ঞাসা করবে,আর জিজ্ঞাসা করে কিইবা লাভ? ভালবাসায় উন্মাদ ব্রাজিলিয়ান মাস তিনেক নিজেকে সামলে,প্রেমে পড়লো আবার,তার ফরাসী ক্লাসের এক আরবের সাথে।ভালবাসার বয়স যখন সপ্তাহ তিনেক,দুজনে চলে গেল জেনেভার বাইরে ছুটি কাটাতে,ফিরে আসার পর পরই রজারের অফিসে ডাক।
অফিসের দরজা খোলার সাথে সাথে জানলো সে চাকরী থেকে বরখাস্ত,কাজের অন্যান্য নর্তকীদের কাছে একটা বেশ খারাপ উদহারন তুলে ধরছে রজার।অনেকটা চীৎকার করেই বললো রজার,বারেবারেই এই ব্রাজিলিয়ান মেয়েরা তার বিশ্বাস ভঙ্গ করছে(কত সহজেই মাঝে মাঝে মানুষ একটা নামতার খাতায় ফেলে দেয়)।মারিয়া অনেক বুঝিয়ে বললো সে জ্বর কাসি নিয়ে বেশ অসুস্থ ছিল,কিন্ত কোনভাবেই বোঝানো গেল না রজারকে।রজার বললো আবার তাকে ছুটতে হবে সামবা নর্তকীর জন্যে,হয়তো বা এর চেয়ে ভাল হতো যুগোস্লাভ নর্তকী নিয়ে আসা,অন্তত এই ঝামেলা তাকে পোহাতে হতো না।
কিন্ত মারিয়া তো বোকা না,আরব প্রেমিকের কাছে শুনেছে সুইস কাজ কর্মের আইনগুলো বেশ কঠিন।যেহেতু নাইট ক্লাবের বেতনের বেশীর ভাগটাই কেটে রাখতো নাইট ক্লাব,মারিয়া দাবী করতে পারে তারা তাকে ব্যাবহার করেছে অনেকটা ক্রীতদাসের মত।
মারিয়া রজারের অফিসে গিয়ে ফরাসী ভাষায় কথা বলে রজারকে জানিয়ে দিল সে যা করছে তা বেয়াইনী,বেশ কবার, “উকিল” কথাটা ব্যাবহার করতে সে দ্বিধা করে নি। ৫০০০ ডলার হাতে নিয়ে ফিরে গেল মারিয়া,যা ছিল তার চিন্তা ধারণার বাইরে, “উকিল” কথাটা একেবারে যাদুর মত কাজ করেছে।মারিয়ার হাতে একগাদা সময়,ঠিক করলো আরব প্রেমিকের সাথে সময় কাঁটিয়ে,কিছু ছবিটবি তুলে সে ফিরে যাবে,ব্রাজিলে।
মারিয়া ব্রাজিলে তার প্রতিবেশীকে ফোন করে জানালো তার মাকে,ভাল আছে সে,বেশ ভাল একটা চাকরীও করছে,তারা কেউ যেন তাকে নিয়ে অযথার চিন্তা না করে।হোটেলের ঘরটাও ছাড়তে হলো তাকে,আরব প্রেমিক ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তার।ভেবে দেখলো আরব প্রেমিকের সাথে ধর্মবদল করে,বিয়ে করলে ক্ষতি কি,মাথায় ঘোমটা তেমন খুব একটা খারাপ না,শুনেছে আরবরা তো সবাই বেশ ধনী।আরব দেশটা কোথায় জানা ছিল না তার,মনে মনে ধন্যবাদ দিল, “মেরীকে”, ধর্ম বদলের ব্যাপারে তখনও মন স্থির করতে পারেনি।ফরাসী ভাষা এখন মারিয়ার বেশ কিছুটা দখলে,প্লেনের টিকিটের টাকাটাও আছে তার হাতে,কাজের অনুমোদন পত্র আছে “সামবা নর্তকী” হিসেবে,ভিসাও আছে।আর কিছু না হলে ফিরে গিয়ে তার মালিককে তো বিয়ে করতেই পারবে,তবে মারিয়া এত সহজে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যেতে রাজী ছিল না।
ব্রাজিলে একটা রাখালের গল্প পড়েছিল,গুপ্তধন খুঁজতে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছিল যাকে,যতই বিপদ বাড়ছিল ততই দৃঢ় হচ্ছিল রাখাল ছেলেটার মানসিকতা।মারিয়ার অবস্থাও অনেকটা তাই,তার ভাগ্য তাকে ঠেলে দেওয়া তাকে এ অবস্থায় যেন সে খুঁজে নেয় তার জীবনের স্বপ্নের দেশটায় যেখানে সে এক নামকরা অভিনেত্রী।
ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করলো,টিভি ছিল না(ঠিক মত টাকা পয়সা উর্পাজন হলে তখন হবে সে গুলোও), কাজ খোঁজা আরম্ভ করলো মারিয়া কর্মসংস্থান সংস্থাগুলোতে,
মোটামুটি সবার উত্তর ছিল,ছবি দরকার তার বেশ কটা,বেশ কিছু টাকা পয়সা খরচ হবে-তবে স্বপ্নের দেশটায় পৌঁছানোটাও অত সহজ হওয়ার কথা নয়। টাকা পয়সার থেকে বেশ বড় একটা অংশ খরচ করলো নামকরা ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলে,নানান ধরণের কাপড়চোপড়ে নানান ধরণের ছবি।কোন কোন ছবিটায় যেন কাপড়ও নেই,কোনটায় একগাদা পোষাক পরা।ফটোগ্রাফারের কথাবার্তা ছিল কম,মারিয়া কটা ছবির কপি চেয়ে রাখলো,তার মা বাবাকে পাঠাতে পারে,যেন তারা ভাবে সে সুখে আছে।সবাই ভাববে বেশ টাকা পয়সা আছে তার,আছে নানান ধরণের পোষাক।পরিকল্পনা যদি সার্থক হয়,তবে মারিয়া ব্রাজিলে ফিরলে তার ছোট্ট শহরটার মেয়র,বেশ জাঁকজমক করে অনুষ্ঠান করবে তার সার্থকতায়।
স্থায়ী কোন ঠিকানা ছিল না,তাই ফোন কিনে নিল সে একটা,ঐ যে আগে পয়সা দেয়া ফোনগুলো,যদি কোন কাজের ডাক আসে।সস্তা চীনা খাবারে দিনগুলো কাটানো,আর সময় কাটানোর জন্যে বই পত্রিকা পড়া।ফোন আসে না, বেশ কিছুটা অবাক মারিয়া,শুধু ড্রাগ বিক্রেতারা ছাড়া আর কেউ যোগাযোগ করে নি।ভাবছিল মারিয়া-হয়তো সে তেমন কোন সুন্দরীই না।কাজের পুরোনো এক বান্ধবীর কাছে জানতে পারলো,ওটাই স্বাভাবিক,কেননা সুইসদের মধ্যে এটাই চলন,মেয়েদের দেখে তারা অন্যচোখে।
মারিয়ার ডাইরী থেকে নেয়াঃ
“আমার তেমন একটা টাকা পয়সা নেই,সামর্থ নেই কোন থিমপার্কে যেয়ে কোন রাইডে চড়ার,শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি আনন্দের চেহারাগুলো।রোলার কোষ্টারে মানুষ ওঠে আনন্দ খোঁজার জন্যে-তবে ওঠার পরেই ভঁয়ে চীৎকার করার পালা সবার,সবাই চায় রোলার কোষ্টারের গাড়ীগুলো যেন থেমে যায় সেই মুহুর্তেই।কি যে ভাবে তারা জানি না?অভিযানে বেরিয়ে বিপদ পড়লেই পিছিয়ে গেলে অভিযানে যাওয়ার কোন মানে আছে কি,ওঠা নামা তো আছেই জীবনের সব পথগুলোয়।
এই মুহুর্তে ভালবাসা নিয়ে চিন্তা করার কোন মানেই হয়না,জানি ভালবাসা আসবে তার আপন সময় নিয়ে।এটাও জানি এখানে আসা সেটা আমার নিয়তি,আর আজ হোক কাল হোক কাজ একটা পাবই।আমার জীবনটাও তো রোলার কোষ্টারের মতই,মাথা ঘোরানো পুরোনো খেলাটা,প্যারাচুটে ঝাঁপিয়ে পড়া অভিযানের নতুন আঙ্গিনায়।জীবনে আছে থমকে যাওয়া,আছে হেটে যাওয়া,আছে পাহাড়ে ওঠা,আছে নেমে যাওয়াটাও।আত্মবিশ্বাসে সাজিয়ে নেওয়া নিজেকে,ভেঙ্গে পড়া ব্যার্থতায়।
খুব একটা সহজ নিজের পরিচিত ছাড়িয়ে অচেনা জায়গায় জীবন কাটানো,জানা নেই ভাষাটা,আচার সংষ্কার,কোন কথাই বোঝা যায় না সহজে,তবে আমার মনে থাকবে ঐ রোলার কোষ্টারের ওঠা নামা।আমার জানতে ইচ্ছে করে,আমার ঘুম ভেঙ্গে যদি দেখি আমি একটা রোলার কোষ্টারে,কেমন হবে অনুভুতিটা আমার?
হয়তো মনে হবে আমার,আটকে পড়া আমি একটা জালে,চীৎকার করবো,নেমে পড়তে চাইবো তখনই।আর বিধাতা যদি ঐ রোলার কোষ্টার চালানোর দায়িত্বে তাহলে না হয় দুঃস্বপ্নটা বদলে আনন্দময় কিছু হতেও পারে।এখন শুধু চারপাশটা দেখে যাওয়া আর জীবনের রোলার কোস্টারে ভেসে যাওয়া”।
০০০০০
মারিয়ার লেখার চমৎকার চিন্তাধারার মতই,সাজিয়ে নিচ্ছিল সে তার জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা।প্রায়ই মনটা ভেঙ্গে পড়ে,কোন ফোন আসে না,কোন কাজের খবর নেই।মনটাকে অন্যদিকে নেওয়ার আশায় সে কেনা আরম্ভ করলো নানান ধরণের পত্রিকাগুলো।ভাড়ায় পত্রিকা পাওয়া যায় কি না খোঁজ নিতে,লাইব্রেরীর মহিলাটা তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা বই দেখিয়ে দিল।
“আমার তো বই পড়ার সময় নেই”।
“কি বলছো তুমি বই পড়ার সময় নাই!কি কর তুমি”?
“অনেক কিছুই,ফরাসী শিখছি,ডাইরী লিখি,আর….”।
“আর কি”?
মারিয়া ভাবছিল বলবে ফোনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকার কথা,তবে ভেবে দেখলো সেটা বলা ঠিক হবে না।
“তোমার বয়স অনেক কম,অনেক পথ পড়ে থাকা তোমার সামনে।পড়াশোনা করো ভুলে যাও,ভুলে যাও যত সব পুরোনো,হারানো”।
“অনেক বই পড়েছি,আমি”।
মারিয়া বুঝতে পারলো,যোগাযোগ কি জিনিষ,বুঝলো ব্রাজিলে ম্যালিসন তাকে যা বোঝাতে চেয়েছিল।লাইব্রেরীর মহিলাটার মন জয় করা দরকার,তার মন বলছিল এটা একটা বন্ধুত্বের যোগাযোগ।
কথা বদলে মারিয়া বললো, “আমি আরও কয়েকটা বই পড়তে চাই।কয়েকটা বই পছন্দ করে দিতে পারবে,আমাকে”?
মহিলাটা ‘ছোট্ট রাজকুমার’ বইটা এনে দিল তাকে।সেই রাতেই মারিয়া পাতা ওলটানো আরম্ভ করলো,প্রথম পাতায় ছবি একটা টুপির,তবে লেখকের মতে যে কোন ছেলে মেয়ের কাছে সেটা একটা সাপ,হাতী লুকিয়ে থাকা মাঝখানে।“আমি কোন সময় শিশু ছিলাম বলে মনে হয়না”, ভাবলো মারিয়া, “আমার কাছে এটা একটা টুপিই মনে হয়”।
টিভির অনুপস্থিতি সে ভরিয়ে রাখলো গল্পের বইটা দিয়ে, “ভালবাসা” কথাটা দিয়ে মনটা খারাপ করা কোন ইচ্ছা ছিল না তার।দুঃখজনক ভালবাসার পর্বগুলো ছাড়া বইটা বেশ আনন্দদায়ক ছিল।বারে বারে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা বন্ধ করলো,লাইব্রেরীতে যাওয়া আরম্ভ করলো প্রায় প্রতিদিনই।লাইব্রেরীয়ানের সাথে গল্প করা,নতুন নতুন বই নিয়ে আসা, আর সপ্তাহ দুয়েক এভাবে কাটালে ব্রাজিলে যাওয়ার প্লেন টিকিটের টাকাটাও শেষ হয়ে যাবে।
জীবনের নানান পর্বের মত অনেক হতাশার ফাঁকে দেখা দেয় আশার আলো, ।তিনটা মাস কেটে যাওয়ার পর ফোনটা বেজে উঠলো,কেউ একজন জানতে চাইলো -সিনোরা মারিয়াকে কি পাওয়া যাবে ঐ নাম্বারে,বেশ ধৈর্যের সাথে উত্তর দিল “হ্যা”,যেন বোঝা না যায় তার অধীর আগ্রহের অপেক্ষা।একজন আরব ফ্যাশন ডিজাইনার,তার ছবি দেখে পোশাকের মডেল হসেবে তাকে নিয়ে যেতে চায়,তার আপত্তি করার কি আছে,টাকা পয়সাও দরকার।
একটা বেশ নাম করা রেস্তোরায় দেখা করলো মারিয়া,সম্ভ্রান্ত চেহারার এক ভদ্রলোক,বয়সে হয়তো রজারের চেয়ে কিছুটা বেশি,
“জান ঐ ছবিটা কার আঁকা?ওটা মিরো,জোয়ান মিরোর নাম জানা আছে তোমার”।
উত্তর দিল না মারিয়া,তখন ব্যাস্ত খাবার নিয়ে,প্রতিদিনের সস্তা চীনা খাবারের বদলে সেগুলো যেন স্বর্গ থেকে পাঠানো খাবার।
আরব ভদ্রলোক বললো,
“এই যে টেবিলে আমরা বসে আছি,ফেলিনি বসেছিল এখানে।ফেলিনির ছবি দেখেছ তুমি”?
মারিয়ার বলার ইচ্ছা ছিল,ফেলিনি তার সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক,বললো, “কোন ভনিতা করবো না আর আমি,শুধু পেপ্সি আর কোকাআকোলার পার্থক্যটা বলতে পারি আমি,তার বেশী তেমন কিছু আমার জানা নেই।ভেবেছিলাম এখানে আমরা মডেলিং সমন্ধে আলাপ আলোচনা করতে এসেছি”।
“খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর আমরা আলোচনা আরম্ভ করবো”।
কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা,দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়া যেন বোঝার চেষ্টা করছিল অন্যের মনের কথাগুলো।
“বেশ সুন্দরী তুমি” বললো লোকটা, “আমার হোটেলে গিয়ে আমার সাথে ড্রিঙ্ক করবে,আমি তোমাকে ১০০০ হাজার ফ্রাংক দিব”।
মারিয়া বুঝতে পারলো তার উদ্দেশ্যটা,ওটা কি মডেল এজেন্সীর দোষ?না মারিয়ার দোষ?তার কি প্রশ্ন করা ছিল যে কি ধরণের খাবারের আমন্ত্রনটা?এটা কারও দোষ না,এটাই নিয়ম হয়তো বা,সময়ের চলার ধরণ।ভেসে উঠলো ব্রাজিলের চেহারা,ভেসে উঠলো তার মায়ের ছবিটা।মনে পড়লো ম্যালিসনের কথা,তার চাওয়া ৩০০ ডলার কমিশনের কথা,যেটা ছিল তার এক রাত যৌনবিহারের চেয়েও বেশী।
সে মুহুর্তে অজানায়,অচেনায়,তার পাশে নেই কেউ যে বলে দিবে কোনটা ঠিক পথ।
“আরেকটু মদ ঢেলে দিল আরবটা,মদের নেশা সহজকরে দিল সিদ্ধান্ত নেওয়া,গল্পের সেই ছোট্ট রাজকুমারের অভিযানের চেয়েও।মারিয়ার জানা ছিল এ ধরণের প্রস্তাব আসবে তার কাছে,এর মধ্যে তার বেশ একটা ধারণা হয়ে গেছে পুরুষদের নিয়ে।তবু বিশ্বাস ছিল মডেলিং এর বিরাট তারকা হবে সে,ধনী কোন লোকের সাথে বিয়ে হবে,সন্তানসন্ততি নাতিপুতি নিয়ে সময় কাটাবে তার নিজের বাড়িতে।
জীবনের কঠোরতা তাকে বুঝিয়ে দিল ওগুলো শুধু স্বপ্নই,নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলো মারিয়া।ব্যাস্ত হয়ে উঠলো আরব ভদ্রলোক কেলেঙ্কারীর ভয়ে,ওয়েটারকে ডেকে তাড়াতাড়ি বিলটা চেয়ে পাঠালো,মারিয়া তাকে থামিয়ে বললো, “না,না।কি করছ তুমি?একটু মদ ঢেলে দাও,আরেকটু কাঁদতে দাও আমাকে”।
মনে পড়লো স্কুলের ছেলেটার কথা,যে পেন্সিল চেয়েছিল তার কাছে,ছেলেটার কথা যে মুখটা বন্ধ রেখে চুমু খেয়েছিল তাকে,রিও ডি জেনোরো দেখে তার অবাক হওয়ার আকাশটা,সেই মানুষগুলো যারা শুধু তকে ব্যাবহার করেছে,এর মাঝে ভালবাসা উচ্ছাস হারিয়ে গেছে কোন সে অজানায়।স্বাধীনতার আকাশটায় বসে বসে ভাবছিল ভালবাসার সেই লাল আলোটার জন্যে,হয়তো সিনেমা গল্পের মত বদলাবে তার আগামীকাল।কোন এক লেখকের বলা-সময় বদলায় না মানুষকে,বদলায় না জ্ঞান অভিজ্ঞতা,যা মানুষকে বদলে দেয় সেটা ভালবাসা,অদ্ভুত এক পাগলামির কথা।যে লেখেছে সে হয়তো শুধু দেখেছে জীবনের একটা দিক,যদিও ভালবাসা বদলে দিতে পারে মানুষের জীবন,তবে অন্য দিকটায় আছে হতাশা যেটা বদলে দিতে পারে মানুষের চেহারা।ভালবাসা অবশ্যই বদলে দিতে পারে মানুষের জীবন,তবে হতাশা বদলে দেয় আরও তাড়াতাড়ি।কি করবে সে?ফিরে যাবে ব্রাজিলে,স্কুলে ফরাসী ভাষা শিক্ষক হবে,পুরোনো মালিককে বিয়ে করে কাটিয়ে দেবে জীবনটা।নাকি সাহস করে এগিয়ে যাবে অন্য পথে,এ শহরটায় তাকে কেই বা চেনে,এটা শুধু এক রাত্রির গল্প একটা।এই এক রাত্রির গল্প কি তাকে নিয়ে যাবে সেই নেশায় ফেরা হয়না যেখান থেকে,এটা একটা সুযোগ নাকি-“মেরীর” পরীক্ষা করা তার বিশ্বাসের মাত্রা।
আরব ভদ্রলোক ঘুরে ঘুরে চারপাশে দেখছিল জোয়ান মিরোর পেইন্টিং,ফেলিনির খাওয়া রেস্তোরায়,দোকানের সুন্দরী মেয়েটাকে।
“তুমি কি এখনও বুঝতে পারনি”?
“আরেকটু মদ আনতে বল”,মারিয়ার চোখ ভঁরা কান্না।
মনে মনে মারিয়া ভাবছিল ওয়েটারটা যেন না আসে,দূর থেকে আড়চোখে ওয়েটারটা ভাবছিল লোকটা বিলটা দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে উদ্ধার করুক তাকে,দোকান ভরা লোক আর অনেকেই অপেক্ষা করে ছিল।
যেন হাজার বছর অপেক্ষার পর মারিয়া জিজ্ঞাসা করলো,
“১০০০ ফ্রাংক শুধু যেয়ে মদ খাওয়ার জন্যে”।
নিজের কথায় নিজেই অবাক হলো মারিয়া,
“হ্যা”,যেন নিজের প্রস্তাবে নিজেই হতাশ হওয়া একটা মানুষ,“আমি চাইব না….”.
“চল বিলটা দিয়ে তোমার হোটেলে চল”।
কথাগুলো তার নিজের কাছেই অচেনা মনে হলো।সেই মুহুর্তের আগে মারিয়া ছিল,হাসিখুশি,
শিক্ষিত একটা মেয়ে,অচেনা অজানা লোকদের সাথে কোন সময় কথা বলেনি।তবে শেষ হয়ে গেল সেই মেয়েটার গল্প,সে এখন ১০০০ ফ্রাংকের মদ খাওয়া ব্যাবসায়ী মেয়েটা।যা যা হওয়ার কথা ছিল ঠিক তাই ঘটলো,হোটেলে যেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হলো,মারিয়া।পা দুটো খুলে দিয়ে অপেক্ষা করে থাকলো সেই চরম সুখনুভূতির(না হলেও তাকে ভান করতে হবে),মার্বেল বাথরুমে নিজেকে পরিষ্কার করে ধোঁয়ামোছা,তারপর ১০০০ ফ্রাংক নিয়ে,অহংকারের সাথে ট্যাক্সি করে বাড়ী ফিরে গেল।
মারিয়ার ডাইরী থেকে নেয়া,পরের দিনের লেখাঃ
“আমার সবকিছুই মনে আছে,শুধু মনে নেই কি ভাবে,কেন এই সিদ্ধান্তটা নিলাম।যদিও আমার কোন অনুশোচনা নেই এ সিদ্ধান্তে।আমি প্রশ্ন ছিল সবসময়,মেয়েরা কি ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়,বুঝলাম এটা শুধু ‘হ্যা’ বা ‘না’ বলা,কেউ তো জোর করে কাউকে কিছু বলাতে পারে না।এই যে রাস্তায় ছুটে যাওয়া সবাই,তারা কি যা করছে তা নিজের সিদ্ধান্তে?নাকি তারা আমার মত ঠেলে দেয়া ‘ভাগ্যের পরিহাসে’।বাড়ীর বৌটা যার ইচ্ছা ছিল মডেল হওয়ার,ব্যাঙ্কের লোকটা যে গায়ক হতে চেয়েছিল,দাঁতের ডাক্তার যার ইচ্ছা ছিল লেখক হওয়ার,মেয়েটা যে অভিনেত্রী হতে চেয়েছিল এখন কাজ করে দোকানে,সবই তো বদলে যাওয়া ভাগ্যের খেলায়।
আমার নিজের হাহুতাশ নেই কোন,আমি শিকার হইনি কারও,ইচ্ছে করলেই আমি ফিরে যেতে পারতাম ঐ রেস্তোরা থেকে,মাথাটা উঁচু করে,খালি পকেটে।রেস্তোরায় আমার সামনে বসে থাকা লোকটাকে একগাদা নীতির কথাও শোনাতে পারতাম,বলতে পারতাম তার সামনে বসে থাকা স্বপ্নকুমারী একজন,যাকে ভালবাসা যায়,প্রেম নিবেদন করা যায়,তবে কেনা যায় না।নানান পদ্ধতিতে আমি হয়তো বলতে পারতাম নানান কথা,আমি ভাগ্যকে সুযোগ দিয়েছি আমার উত্তরটা জানানোর।
আমি শুধু একা নই,ভাগ্য,নিয়তি ঠেলে দেয়া আইনের বাইরে সমাজের বাইরের,একজন।সুখের সন্ধানে আমরা সবাই এক,কেউ সুখী নই আমরা,না বৌটা,না দাঁতের ডাক্তার,না ব্যাঙ্কের কর্মচারী,না দোকানের কাজের মেয়েটা।
এ ভাবেই ঘটে যায় কতকিছু,কত সহজেই বদলে যায় জীবনের গান।অজানা এক শহরে একা,গতকাল যা তার মনটাকে হতাশায় তছনছ করে দিচ্ছিল,আজ সেটাই তার মনে এনে দিল স্বাধীনতার সুর,কারও কাছে তার কিছু ব্যাখা করার নেই,এটাতো তার জীবন।
ঠিক করলো প্রথম বারের মত,দিনটা কাটিয়ে দেবে নিজেকে নিয়ে,ভাববে তার বর্তমান,ভবিষৎ।লোকে কি বলে সেটাই ছিল তার কাছে প্রধান,তার মা,তার বান্ধবীরা,তার বাবা,মডেল এজেন্সীর লোকজন,রেস্তোরার ওয়েটার,লাইব্রেরীর মহিলাটা,রাস্তার হেঁটে যাওয়া অজানা লোকজন,সে নিজেকে নিয়ে আসতে চায় তার নিজের রাজ্যে।কেউই কোনদিন ভাবে নি তাকে নিয়ে,ভাববে না কেউ এক জন গরীব বিদেশিনির কথা,হঠাৎ যদি সে কালকে হারিয়ে যায় কোন অজানায়,কেউ অনুভব ও করবে না,তার অস্তিত্বের কথা।সবাই শুধু নিজের জন্যে,কার কি বা যায় আসে”।
সূত্র: নেট থেকে সংগৃহিত চতুর্মাত্রিক।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ০৪, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,