অনুবাদে ইললু।
সপ্তম অংশ
তিনটা মাস চলে গেল,শরত বাতাসের দোলা চারপাশে,ক্যালেন্ডারে মারিয়া দাগ দিয়ে রেখেছে তিন মাস পরে ব্রাজিলে যাওয়ার দিনটা।সব কিছুই অদ্ভুত ভাবে বদলাচ্ছে চারপাশে-চলছে দ্রুতগতিতে,আবার থমকে ফিরে আসছে স্থবিরতায়,পৃথিবীটা যেন ভাগ করা দুটো সময়ের খাতায়।দুটো পৃথিবীর অভিযানগুলো অনেকটা ফুরিয়ে যাচ্ছে,যদিও সে চালিয়ে যেতে পারে তার অভিযান আরও,তবে তার অদৃশ্য মুখটা,বারে বারে তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে,তোমার দেখাটা-দেখা নয়।
যতই এগিয়ে যাচ্ছে জীবনের অভিযানে,এটুকু শিখেছ,যে কোন অভিযানেই যবনিকা টেনে দেওয়ার একটা সময় আছে।আর তিনটা মাস তারপর ফিরে যাবে ব্রাজিলে,একটা খামার বাড়ী কিনে(হিসেবের চেয়ে অনেক বেশিটাই উর্পাজন তার),গরু কিনবে কটা(ব্রাজিলিয়ান গরু,সুইস না),মা বাবাকে সাথে এসে থাকার জন্য আমন্রন জানাবে,কটা কাজের লোকও রাখবে আরাম আয়েসের জন্যে।
তার বিশ্বাস ভালবাসাই সত্যিকারের স্বাধীনতা,যেখানে কেউ কারও অধীন নয়।তার মনের মাঝে লুকিয়ে আছে প্রতিশোধের ইচ্ছা একটা,তাই সে বিজয়ী হয়ে ফিরতে চায় ব্রাজিলে।খামার বাড়ি কিনে নিয়ে,বেশ কিছু টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিবে,তার পুরোনো প্রেমিক ছেলেটা কাজ করে যে ব্যাঙ্কে,সেখানে-যে তার এক বান্ধবীর সাথে তাকে প্রতারনা করেছিল।
“কেমন আছ?মনে পড়ে আমাকে”?ছেলেটা বলবে,মারিয়া ভাব দেখাবে না চেনার,বলবে সে ফিরে এসেছে বছর খানেক, ‘ইউ—রোপে’ কাটিয়ে(কথাগুলো বলবে বেশ ধরে ধরে,তার সহকর্মীরাও যেন শুনতে পায়),হয়তো বলবে ‘সুই—জার—ল্যান্ড’(সেটাই হয়তো শোনাবে আরও ভাল),যেখানে পৃথিবির নামীদামি ব্যাঙ্কগুলো আছে।
জানতে চাইবে,কে সে?উত্তরে হয়তো শুনবে তাদের স্কুল দিনগুলোর কথা।কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বলবে, “ও,হ্যা,কিছুটা মনে পড়ছে আমার—“,তবে তার ভাবভঙ্গী হবে এমন যে আসলে সে চিনতে পারেনি।প্রতিহিংসার স্বাদ,আনন্দ থাকবে তার ঠোঁটে,উল্লাস মুখে।খামারের কাজে ব্যাস্ত থাকবে,কঠোর পরিশ্রম তাকে এনে দেবে সার্থকতা,খুঁজে বের করবে তার মনের মানুষটাকে,লুকোনো আছে কোন এক অজানায়-এখনও দেখা পায়নি যার।
এগার মিনিট নিয়ে বই লেখার কথাটা মন থেকে মুছে ফেললো মারিয়া,ব্যাস্ত হয়ে পড়লো স্বপ্নের খামার বাড়ীর পরিকল্পনা নিয়ে,না হলে তো তার ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।বিকেলের দিকে তার একমাত্র বন্ধু লাইব্রেরীয়ানের সাথে দেখা করতে গেল, কটা বই আনলো খামার বাড়ী নিয়ে,লেখা।
লাইব্রেরীয়ান বললো,
“জান,মাস কয়েক আগে তুমি যখন যৌনসঙ্গম,শরীর খেলার বইপত্র খুঁজছিলে,ভঁয় হচ্ছিল তুমিও একগাদা সুন্দরী মেয়েদের মত সহজ উর্পাজনের মরীচিকার পেছনে ছুটছো।যারা ভুলে যায় বয়স বদলাবে,ভাঁটা পড়বে যৌবনে,এক সময় একা হয়ে যাবে তারা,খুঁজে পাবে না ভালবাসা,দেখা হবে না তাদের ভালবাসার আকাশটা”।
“তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ বেশ্যাগিরির কথা”।
“ওটা বেশ একটা রুঢ় মন্তব্য হয়ে গেল,না”?
“যাকগে তোমার হয়তো মনে নেই,যদিও আগে বলেছিলাম আমি একটা কোম্পানীতে কাজ করি,যারা মাংস রপ্তানী করে।তবে যদি একটা পতিতাই হতাম,সেটা কি খুব খারাপ হতো যদি সময়মত বেরিয়ে আসতাম,ঐ কাজের থেকে।এটাতো সত্যি কথা ভুল করা জীবন,
যৌবনের একটা অংশ”।
“জান,যারা নেশা করে তারাও একই কথা বলে,জানা দরকার কখন তুমি ছেড়ে যেতে পারবে”।
“তুমি নিশ্চয় বেশ সুন্দরী ছিলে তোমার সময়কালে,আর এমন একটা দেশে বাস করো,
যেখানে আছে শৃঙ্খলা,বল তবু তুমি কি সুখী”?
“এটা আমার গর্ব আমি জীবনের সংগ্রামে হার মানিনি,কোন না কোন ভাবে টেনে এগিয়ে নিয়ে গেছি নিজেকে”।
ভাবলো মারিয়া লাইব্রেরীয়ান মেয়েটার সাথে এভাবে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাবে কিনা,মহিলার জানা দরকার জীবনের উল্টো দিকটা।
“আমার ছোটবেলাটা ছিল বেশ আনন্দের,বের্নের ভাল একটা স্কুলে লেখাপড়া,স্কুল সেরে জেনেভাতে এলাম,দেখা হলো ভালবাসার মানুষটার সাথে।প্রেম,বিয়ে করে সংসার পাতলাম,
আমার ভালবাসার জন্যে কোন বির্সজনে দ্বিধা করিনি,আর আমার স্বামীও করেছে তার অংশ।বয়স কালে অবসর নিয়েছিল,যখন সে তার পচ্ছন্দের কাজগুলো করতে গিয়ে দেখলো সময় তাকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূরে,নিজেকে নিয়ে সে ভাবেনি কোনদিন,ভাবার সময় পায়নি।আমরা খুব একটা ঝগড়াও করিনি,সে আমাকে ঠকায়নি কখনও,খুব সাধারণ জীবন যাত্রা ছিল আমাদের।কোন প্রাচুর্যতা ছিল না,একটা সহজ সাধারণ জীবন।হঠাৎ করে অবসর নেয়ায় জীবনটায় এলো,বিরাট শূন্যতা,হতাশা-নিজেকে একেবারে একটা অর্কমন্য মনে হত তার,বছর খানেক পরেই মারা গেল ক্যান্সার রোগে”।
যদিও সত্যি কথাটাই বলছিল সে,ভাবছিল মেয়েটা হয়তো একটা ভুল ধারণা তৈরী করছে।
“আমার মনে হয় অবাক হওয়ার পর্ব ছাড়াই চালিয়ে নেওয়া উচিত আমাদের জীবনটা,যা আমাদের জীবনে দেয় বেঁচে থাকার উৎসাহ।ওটা না থাকায় আমার স্বামী মারা গেল হতাশায়,শূন্যতায়,না হলে হয়তো আরও কিছুদিন সঙ্গ পেতাম তার,কে জানে”।
০০০০০০০০
ফাঁকা বিকেলটায়,হেঁটে হেঁটে ঘুরছিল মারিয়া শহরের অন্য দিকটায়,দেখলো একটা পোষ্টারে সূর্যের ছবি,পাশে লেখা “সান্তিয়াগো যাওয়ার পথ”,কি বলতে চাইছে ছবিটা।পাশেই একটা বার,হয়তো জেনে নিতে পারবে সেখানে,প্রশ্ন থাকলে উত্তর জেনে নেয়ার উপায় একটাই,প্রশ্ন করে।
“আমি জানি না,আমার কোন ধারণা নেই”,মেয়েটা উত্তর দিল।বেশ দামি বার,কফির দামটাই প্রায় তিনগুন,মারিয়া সিদ্ধান্ত নিল ঘন্টাখানেক কাটানোর বসে বসে পড়বে তার খামারের বইটা।একেবারে রসকষ বিহীন একটা বই যদিও,তবে তার খদ্দেরদের সাথে আলাপ আলোচনা,
করার জন্যে সুবিধা হবে,বাড়তি কিছু টাকা পয়সাও আসবে।কফি শেষ করে দাম আর বড় সড় একটা বখশীশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে(তার বিশ্বাস তুমি যা দিবে,ফিরে পাবে তার অনেকগুন বেশী)।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে কথাটা ভেসে এলো,যা বদলে দিল তার আকাশ,তার খামারের চিন্তা,
“একটু দাঁড়াও”।
কিছুটা অবাক হয়েই আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো সে।এটা তো সস্তাদরের কোন বার না,এটা তো কোপাকাবানা না,যেখানে পুরুষেরা যে কোন ধরণের আমন্ত্রন জানাতে পারে,অবশ্যই সে উত্তর দিয়ে চলে যেতে পারে, “না।আমি চলে যাচ্ছি,কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না”।
চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল,তবে কৌতুহল আটকে রাখলো তাকে।অদ্ভুত এক দৃশ্য,বছর তিরিশ লম্বা চুলের এক পুরুষ,হাঁটু গেড়ে বসে আছে মেঝেতে,হাতে ছবি আঁকার একটা ব্রাশ(বলা উচিত ছিল বছর তিরিশের একটা ছেলে?বুড়িয়ে যাওয়া দ্রুত)।চেয়ারে বসে আছে আরেকজন ভদ্রলোক হাতে ককটেলের গ্লাস,বারে যখন ঢুকেছিল,সে খেয়াল করেনি তাদের।ব্রাশ হাতে শিল্পীটা বললো, “ওর ছবি আঁকাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে,তোমার একটা ছবি আঁকতে চাই”।
মারিয়া উত্তর দিতে চাইলো,তাই বললো, “আমি তো ছবি চাই না,আমার কোন ছবির দরকার নেই”।
“জান,তোমার চারপাশটায় ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক জ্যোতি,আর কিছু না হোক আমাকে অন্তঃত একটা স্কেচ করতে দাও,না হয়”।
“স্কেচ”,সেটা কি জিনিষ,আর অদ্ভুত জ্যোতিটা,সেটাই বা কি?লোকটাকে,দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো বেশ ভাল একজন শিল্পী।মারিয়ার কল্পনা উড়িয়ে নিয়ে গেল তাকে নতুন এক আকাশে,কোনদিন যদি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যায় শিল্পী,মারিয়ার নামটাও অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের খাতায়।প্যারিসে সবাই জানবে তাকে,জানবে তার শহর সালভাদার ডে বাইহিয়াতে।
লোকটা কি করছে মেঝে বসে এ ধরণের নামীদামী একটা ক্লাবে,বুঝে উঠতে পারেনি সে।তার মনের কথাটা যেন বুঝে নিয়েই একজন ওয়েটার বললো, “জান ঐ লোক,খুব নাম করা একজন শিল্পী”। বললো, “প্রায়ই আসে এখানে,সাথে শহরের নামী দামী কোন লোক।ও ভাবে এখানকার পরিবেশ তাকে অদ্ভুত ভাবে উদ্ধুদ্ধ করে।টাউন হলের পয়সায় আঁকছে এই ছবিগুলো”।
মারিয়া দেখছিল চেয়ারে বসে থাকা লোকটাকে।ওয়েটার আবার বললো, “একজন নাম করা কেমিষ্ট,শুনেছি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে।আশ্চয্যজনক কিছু একটা আবিষ্কার আছে তার”।
“যেও না”,আবার বললো শিল্পী।“মিনিট পাঁচেক লাগবে,এর মধ্যেই আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে।ককটেল,মদ অন্য কোন ড্রিঙ্ক যেটা ভাল লাগে অর্ডার দিতে পার”।
এক মায়াবী জালে জড়িয়ে পড়েছে মারিয়া,হারিয়ে ফেলেছে নিজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাটা,বারে সে অর্ডার দিল ককটেল আনিসেট(মদ খাওয়ারর অভ্যাস ছিল না,তাই নোবেল বিজয়ীর দেখাদেখি ড্রিঙ্কটাই সে অর্ডার দিল)।
“আমি তো এই শহরের কোন অংশ নই”,লোকটার মনে নিশ্চয় অন্য কোন অভিসন্ধি আছে।আমার মনের মানুষের সাথে ওর কোন মিল নেই,ঐ এগার মিনিট,সেই বিশেষ এগার মিনিট,আর কি হতে পারে।একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি কি, ওয়েটারটাই ঠিক বলেছে, হয়তো নতুন একটা আঙ্গিনা খুলে যেতে পারে।
দেখলো কত আয়েশে তুলির শেষ প্রলেপ টেনে দিচ্ছিল লোকটা।বড় ক্যানভাসটা,
মুড়িয়ে রাখলো শিল্পী,দেখার সুযোগ হলো না তার সম্পূর্ন ছবিটা।এটা যদি একটা সূযোগ হয়?লোকটা(ছেলে নয়),দেখে মনে হচ্ছিল না তার সাথে রাত কাটানোর মত একজন।মিনিট পাঁচেক শেষ হয়ে গেল ছবিটা,মারিয়া ভাবছিল ব্রাজিলের কথা,তার ভবিষৎ,নতুন কোন মানুষের সাথে মেশার অযথার উৎসাহে নষ্ট হবে তার ভবিষৎ কল্পনা।
“ঠিক আছে,শেষ”,লোকটা জানালো কেমিষ্টকে,হঠাৎ যেন জেগে লোকটা উঠলো কোন স্বপ্ন থেকে।মারিয়ার দিকে তাকিয়ে সে বললো, “ঐ কোনটায় বস,ওখানেই আলোটা ভাল”।
সব কিছু সাজিয়ে দেওয়া নিয়তির আকাশটায়,মনে হলো লোকটাকে যেন যুগ যুগ
ধরে চেনা তার-স্বপ্নে দেখা হয়েছিল হয়তো,এখন দেখা তাদের বাস্তবে।মারিয়া ককটেল গ্লাস,হাতে খামারের বইটা,নিয়ে খুঁজে নিল আলো ছড়ানো একটা জায়গা।বিরাট এক ক্যানভাস,কটা ব্রাশ,ছোট ছোট কটা বোতলে নানান ধরণের রং,সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে লোকটা হাটু গেড়ে বসলো মারিয়ার পাশে।
“শোন,এখন আর নড়াচড়া করবে না,একেবারে চুপচাপ বসে থাক”।
“সেটাতো অনেক কিছু চাওয়া আমার কাছে,আমার জীবনটা তো ভেসে যাচ্ছে স্রোতে স্রোতে”।
মারিয়া নিজেই অবাক হলো তার উত্তরে,বলার ধরণটা ছিল বেশ সরস,না শোনার ভান করে লোকটা তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।নিজেকে সহজ করে নেয়ার জন্যে মারিয়া জিজ্ঞাসা করলো,”ঐ যে লেখাটা সান্তিয়াগো যাওয়ার পথ,জান,কোথায় যাওয়া যায় ঐ রাস্তায়”।
“শুনেছি ওটা পুরোনো দিনের তীর্থযাত্রার রাস্তা,একসময় ইউরোপের লোকজন যেত তীর্থে,স্পেনের শহর সান্তিয়াগো ডে কোম্পেসটোলায়”।
ক্যানভাসটা একপাশে মুড়িয়ে নিয়ে তুলির টান টেনে চললো লোকটা।
মারিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না,তার কি করা দরকার।
“আমি যদি ঐ রাস্তা দিয়ে যাই,আমি কি স্পেনে পৌছাব”।
“হ্যা পৌঁছাবে মনে হয়,ঐ দু তিন মাস লাগবে আর কি,শোন একটা অনুরোধ কথা বলো না আর,মিনিট দশেক লাগবে খুব বেশী হলে,এর চেয়ে বেশী না।টেবিলের উপর রাখা জিনিষটা সরিয়ে নাও”।
“ওগুলো বই”,কিছুটা অস্বস্তির সাথেই মারিয়া উত্তর দিল,লোকটার কথা বলার ধরণ শুনে।সে বোঝাতে চাইলো তার সামনে হাঁটু গেড়ে থাকা মেয়েটা একজন নির্বোধ কেউ না,ঘোরাফেরা আছে তার সাহিত্য,সংষ্কৃতির জগতে,আছে লাইব্রেরীতেও যাতায়াত।কথা না বাড়িয়ে লোকটা নিজেই বই এর প্যাকেটটা তুলে নিয়ে,অনেকটা ছুঁড়েই দিল মেঝেটায়।
তার কথাবার্তায় হয়তো তেমন একটা দাগ কাটেনি লোকটার মনে,কিন্ত সেটা তার উদ্দেশ্যও ছিল না।তা ছাড়া সে তো কাজে নেই,মোহিনী রুপটা সে অন্য সময়ের জন্যেই ধরে রাখবে।কি দরকার একজন শিল্পীর সাথে সম্পর্ক বাড়িয়ে,কি লাভ এমন একজনের সাথে সম্পর্কে-যার হয়তো নিজেরই খাওয়া নিয়ে টানাটানি।তিরিশের একটা লোক-লম্বা লম্বা চুল,একেবারেই বেখাপ্পা একটা চেহারা।কেন সে ভাবছে তার টাকাপয়সার অভাব?ওয়েটারটা তো বললোই সে বেশ বিখ্যাত,নাকি ঐ নোবেল প্রাইজ পাওয়া কেমিষ্ট এর কথা।তার পোশাক আশাক একটু পরখ করে দেখলো সে,তেমন একটা বোঝা গেল না কিছু।জীবন চলার ওঠা নামায় এটুকু শিখেছে সে,পোশাকআশাকে উন্নাসিক মানুষগুলোর চেয়ে,ওই ঝকঝকে পোশাক পরা মানুষগুলোর টাকা পয়সা অনেক কম।
‘কেন অযথা আমি ভাবছি মানুষটাকে নিয়ে?আমার কৌতুহল তো শুধু ওর আঁকা ছবি নিয়ে’।তার দশ মিনিট সময়ের দামের চেয়ে একটা ছবিতে চিরসুন্দর হয়ে থাকার সূযোগটা কি কম?দেখলো নামী দামী কেমিষ্টটার পাশে তার ছবি আঁকছে লোকটা,তবে তার কাছে সে কোন টাকা পয়সা চাবে,নাকি আবার?
“জানালার দিকে তাকিয়ে থাক”।
মেনে নিয়ে জানালার দিকে ঘুরে গেল মারিয়া,যা তার স্বভাবের সম্পুর্ন উল্টো।দেখা আরম্ভ করলো হেঁটে যাওয়া লোকজন,রাস্তার সাইনবোর্ডটা,ভেবে চললো কি ভাবে ওই রাস্তাটা ওখানেই আছে যুগ যুগ ধরে,কি ভাবে টিকে আছে চারপাশের পরিবর্তনের ধাক্কায়।হয়তো তার ছবিটাও থাকবে কোন মিউজিয়ামে,পাচশ বছর পরে…।
ছবি আঁকা আরম্ভ করলো লোকটা,তবে মারিয়া এর মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে তার উৎসাহের পর্ব,নিজেকে তার মনে হলো উছিষ্ট।সে একটা দৃঢমনা মেয়ে,একটা বেশ ভাল বেতনের কাজ ছেড়ে,অন্য কাজে চলে গেল সে,দেশ গিয়ে খামারে কাজ করবে…।
জীবনের অনিশ্চয়তাগুলো সোচ্চার হয়ে উঠছিল তার মনে,যা যে কোন পতিতাকে ঠেলে দেয়,ধ্বংসের পথে।
বুঝে উঠলো-তার অনিশ্চয়তা,অস্বস্তির কারণ,প্রথমবারের মত তাকে কেউ বাজারের পন্য হিসেবে নয়,একটা মেয়ে হিসেবেও নয়,এমন কিছু ভাবছে যা তার বোঝার ক্ষমতা নেই।তার মনে হলো, “আমার ভেতরটা দেখে ফেলছে লোকটা,দেখে ফেলছে ভঁয়গুলো আমার,মানসিক ভঙ্গুরতা,যে পৃথিবীটাতে আমি একেবারেই অচল”।
ধুর,ওটা হয়তো শুধুই শুধু আমার কল্পনা…।
হয়তো…।
“কথা বলো না”লোকটা বললো।“তোমার মনের আলোটা ছুঁয়ে যাছে,আমার মন”।
কোনদিন শোনা ছিল না,তার ঐ ধরণের কথা।
“তোমার সুডৌল স্তন দুটো,আমার চোখের সামনে এখন”।
“দেখছি আমি,চোখ জুড়ানো মসৃন,থামের মত উরু”।
“তুমি যেন প্রাচ্যের এক সুন্দরী”।
কম করে হলেও, “আমি দেখছি,এই জীবন ছেড়ে যেতে চাও তুমি।তোমাকে একট এর্পাটমেন্ট সাজিয়ে দেব”
এ ধরণের কথা তার কাছে নতুন নয়,তবে তার মনের আলো?সে কি সন্ধ্যা আলোর কথা বলছিল?
“আলো,তোমার মনের আলো,” বলে উঠলো লোকটা,যেন বুঝতে পেরেছে মারিয়ার মনের প্রশ্ন।মনের আলো,জানা নেই কি বলতে চাচ্ছে শিল্পী,তিরিশ বছর হয়তো কিছুই শেখা হয়নি তার।তবে এটাতো সবারই জানা,মেয়েদের জীবন অভিজ্ঞতা অর্জন করার ক্ষমতা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশী।মারিয়া বিনিদ্র রজনী যাপন করেনি জীবন দর্শন নিয়ে।শিল্পীর বলা,“মনের আলো”,তার কাছে ছিল, “ছড়ানো আলোর চারপাশ”।আর দশজনের মতই,তার যন্ত্রনা সহ্য করে যাওয়া নীরবে,যা সিদ্ধান্ত নেওয়া সেটাই ঠিক এটা ভেবে নেয়া তার।ভাব দেখানো সে বেশ শক্ত,যদিও মনটা না নড়বড়।তার কাজের পর্ব শেষ হয়ে আসছে,দুঃখ তার মনের আলোটা দেখা হলো না।
হয়তো মনের আলো না,সে তো বলতে পারতো, “অদ্ভুত সুন্দরী তুমি”।আলো কি ভাবে ঢোকে ঘরের মধ্যে?খোলা জানালো দিয়ে?আলো কি ভাবে ঢোকে মানুষের মধ্যে?হয়তো ভালবাসার খোলা জানালা দিয়ে?তার দরজাগুলো তো বন্ধ সেই কবে থেকে?হয়তো সে তেমনে কোন ভাল শিল্পী নয়,কিছুই জানে না।
“যাক শেষ হয়ে গেছে”,বলে তার জিনিষপত্রগুলো গুছিয়ে নেয়া আরম্ভ করলো।
মারিয়া তবুও চুপচাপ বসে থাকলো,ইচ্ছা হচ্ছিল তার যদি ছবিটা দেখা যায়,তবে সেটা বলা হয়তো কিছুটা রুঢ়তা হবে,শোনাবে যেন শেষ হয়নি তার ছবি আঁকা।কিন্ত কৌতুহল ছাপিয়ে গেল মারিয়ার মনটা,বলেই ফেললো সে,লোকটা আপত্তি না করে দেখালো।একটা মুখ আঁকা ছবিটায়,মুখটা দেখতে তার মতই,তবে অনেক দিন পর ছবিটা দেখলে যদি তার জানা না থাকতো মডেলটা কে,মনে হতো তার ওটা কোন দৃঢ়মনা এক মেয়ের ছবি,”আলো” একটা ছড়িয়ে পড়া তার চারপাশ,কোন আয়নায় দেখা যায় না যা।
“আমার নাম রালফ হার্ট।আপত্তি যদি না থাকে তোমাকে আরেকটা ড্রিঙ্ক কিনে দিতে চাই”।
“না থাক আর না,ধন্যবাদ”।
সেই পুরোনো নিয়মে একটা মেয়েকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা।
মারিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বললো, “আর দুটো ককটেল,আনিসেট”।
আর কি করবে সে?খামার সমন্ধে রসকষবিহীন বইটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে,নাকি লেকের চারপাশটায় অযথা ঘুরে বেড়ানো যা প্রায়ই করে সে।নাকি কথা বলবে সেই মানুষটার সাথে যে খুঁজে পেয়েছে তার মনের লুকানো আলোটা,ক্যালেন্ডারে চিহ্ন দিয়ে রাখবে সেই দিনটা।
“কি কর তুমি”?
সূত্রঃ চতুর্মাত্রিক।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,