লেখক:মাসুদ মিলাদ।
চায়ের সাম্রাজ্য তখন ব্রিটিশদের হাতে। তাদের কাছ থেকে একটি বাগান কিনে চা উৎপাদনে যুক্ত হন সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের শিক্ষক মজ্দ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এটি ১৯২১ সালের কথা। চায়ের ব্যবসা পরিচালনায় নিজের নামে তিনি গড়ে তোলেন ‘এম আহমেদ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি’। এ বছর ১০০ বছর পূর্ণ করেছে ঐতিহ্যবাহী এই কোম্পানি।
চা উৎপাদনে গত দুই দশকে দেশের ১৮টি শিল্পগোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগই মূলত গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চা উৎপাদনে যুক্ত হয়। এই খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি গ্রুপ ২০০ বছর ধরে চায়ের ব্যবসা করলেও উৎপাদন কার্যক্রমে যুক্ত হয় ১৯৬০ সালের দিকে।
শতবর্ষ আগে মজ্দ উদ্দিন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত এম আহমেদ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি এখন পরিচালনা করছে তাঁর তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্ম। চা উৎপাদন ও বিপণন মূল ব্যবসা হলেও এই গোষ্ঠীর ব্যাংকিং, আবাসন, টেক্সটাইল, কোল্ডস্টোরেজ (হিমাগার), খাদ্যপণ্য, মসলা, কৃষি ও রাবার খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে চার হাজার মানুষের।
মজ্দ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর জন্ম সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি ১৯১৩ সালে সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের আবাদ ও বিপণন সবকিছুতেই ছিল ব্রিটিশদের আধিপত্য। মজ্দ উদ্দিন আহমেদ চায়ের আবাদ দেখে মুগ্ধ হতেন এবং নিজেও চা-বাগানের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অবশেষে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ অক্টাভিয়াস স্টিল অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় চান্দবাগ চা-বাগান কিনে নেন তিনি। এরপর আরও কয়েকটি চা-বাগানের মালিক হন তিনি। দেশভাগের সময়ে অবশ্য আসাম ও ত্রিপুরার দুটি বাগান বিক্রি করে দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত চান্দবাগ চা-বাগানসহ ছয়টি বাগানের মালিকানা আসে তাঁর হাতে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, চা-বাগানের পাশাপাশি শিক্ষকতাও চালিয়ে গেছেন মজ্দ উদ্দিন আহমেদ। প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করে একপর্যায়ে সিলেটের এমসি কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯৪৪ সালে অবসর নেন। অবসরেও চা উৎপাদনে নজর দিতে ভোলেননি। তাঁর পরে ছেলে মহিউস সুন্নত চৌধুরী কোম্পানির নেতৃত্বভার নেন। বাবার দেখানো পথ ধরে এম সুন্নত চৌধুরীও চায়ের আবাদ বাড়ান। তাঁর তিন ছেলে মো. সাফওয়ান চৌধুরী, মো. হাসান চৌধুরী এবং মো. তেহসিন চৌধুরীও চা শিল্পে জড়িত হন। চতুর্থ প্রজন্মও ইতিমধ্যে পারিবারিক ব্যবসায়ে জড়িয়েছে। তাঁরা হলেন সাফওয়ান চৌধুরীর দুই ছেলে সাবেত নাঈম চৌধুরী ও সাজিদ আবদুল্লাহ চৌধুরী এবং মো. হাসান চৌধুরীর মেয়ে ফাহিমা আয়েশা চৌধুরী। সবাই কোম্পানির পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
এম আহমেদ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাফওয়ান চৌধুরী ব্যাংক এশিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০০ বছর আগে চান্দবাগ চা-বাগান দিয়ে আমার দাদা চা উৎপাদনে যুক্ত হয়েছিলেন। এই এক বাগান থেকে ধীরে ধীরে আটটি বাগান হয়েছে। চা উৎপাদন ও বিপণনের ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিতে চাই।’
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী গত ২০১৯ সালে এম আহমেদ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানির আটটি বাগানে ৩১ লাখ ৮৫ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালে করোনার মধ্যে উৎপাদন কিছুটা কমে ২৮ লাখ ৮৮ হাজার কেজিতে নামে। একই সময়ে দেশের ১৬৭টি বাগানে মোট চা উৎপাদিত হয় ৮ কোটি ৬৪ লাখ কেজি। সেই হিসাবে দেশে মোট চায়ের ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ উৎপাদন করছে এম আহমেদ টি।
এম আহমেদ গ্রুপের সূত্রে জানা গেছে, চা উৎপাদনের ৭৭ বছর পর ১৯৯৮ সালে তারা ম্যাগনোলিয়া ব্র্যান্ড নামে চা বাজারজাতকরণ কার্যক্রমে জড়িত হয়। চা উৎপাদকেরা নিজেদের বাগান থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বাজারজাত করতে পারেন। এর বেশি হলে নিলাম থেকে কিনে বাজারজাত করতে হয়। কয়েক বছরে নিলামে চা বিক্রির তালিকা থেকে দেখা যায়, নিলামে শীর্ষ ক্রেতার তালিকায় কোনো না কোনো বছরে এম আহমেদ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি শীর্ষ দশে থাকে। বর্তমানে তারা বছরে ম্যাগনোলিয়া ব্র্যান্ডের কমবেশি ২০ লাখ কেজি চা বাজারজাত করে।
১৮৭৩ সালে বাংলায় চা চাষবিষয়ক গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গলের কৃষি বিভাগের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ আমলে ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকার ‘পাইওনিয়ার’ বাগানে পরীক্ষামূলক আবাদ শুরু হয়। তবে চট্টগ্রামে প্রথম চাষ শুরু হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বাংলাদেশ অংশে (তৎকালীন বাংলা) বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম চা চাষ শুরু হয় সিলেটে। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মালনীছড়া চা-বাগানে ১৮৫৭ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।
জানতে চাইলে সাজিদ আবদুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক ও শ্রমিক কল্যাণে প্রতিষ্ঠাতার যে মূল্যবোধ ছিল, তা থেকে বিগত ১০০ বছরেও বিচ্যুত হননি আমাদের বাপ-দাদারা। শ্রমিকদের কল্যাণের পাশাপাশি চায়ের গুণগত মান বজায় রাখার ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় শতবর্ষ পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে আমরা এই কোম্পানিকে আরও এগিয়ে নিতে চাই।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ১৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,