লেখক: উজ্জ্বল মেহেদী, সিলেট।
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের শিকার নারীটি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন এত দিন। স্বামী বা পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সামনে যেতেন না, কথাও বলতেন না। নিজেকে আড়াল করে রেখে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটত তাঁর সময়। মানবাধিকার সংস্থা, আইনজীবী ও স্বামীর সহায়তায় এখন তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আবার পড়াশোনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হতে চান। তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বর্বরতাকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছেন। তবে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান তিনি।
দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমার ভিতর ভয় ঢুকে গেছিল, এখনো ভয় কাটছে না। তবে আর ভয়ে থাকতাম না।’
২৪ সেপ্টেম্বর রাতে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেছেন ওই নারী। এক বছর আগেকার ওই ঘটনার পর এই প্রথম তিনি কোনো সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন।
সিলেট নগরে আইনজীবীর চেম্বারে মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে স্বামীকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় তাঁর সঙ্গে মানবাধিকারকর্মী ও বাদীপক্ষের মামলা পরিচালনায় থাকা আইনজীবী প্যানেলের সদস্যরা ছিলেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সিলেটের বিভাগীয় প্রতিনিধি সৈয়দ আকরাম আল সাহান জানিয়েছেন, ঘটনার পর মাসখানেক শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন মেয়েটি। অসুস্থ অবস্থাতেই আদালতে জবানবন্দি দেন।
এরপর নিজেকে অনেকটা আড়ালে নিয়ে যান। এর মধ্যে একদিন বাবার বাড়িতে গিয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীদের বিড়ম্বনার মুখে পড়েন। সেখান থেকে স্বামীর পরিবারে গিয়েও একই অবস্থার মুখে পড়েছিলেন।
এই অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর স্বামীর মাধ্যমে খবর পেয়ে মানবাধিকার সংগঠনটি একজন নারী কাউন্সিলরকে মেয়েটির পাশে নিযুক্ত করে। একটানা ছয় মাস নিরবচ্ছিন্ন কাউন্সেলিং চলে।
মানবাধিকার সংগঠনের ওই নারী কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দফায় কাউন্সেলিংয়ের পর উন্নতি দেখা যায়। আরও তিন মাস কাউন্সেলিং শেষে তিনি যেন নিজেকে ফিরে পান।
ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েটি প্রথম আলোকে বললেন, যা ঘটেছে, তার বিচার হোক। কিন্তু তিনি আর নিজেকে সে ঘটনার মধ্যে আটকে রেখে বসে থাকবেন না। গত বছর এইচএসসির ফরম পূরণ করতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। এবার পরীক্ষা দেবেন।
মানবাধিকারকর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহান বলেন, মেয়েটি যে কলেজের অনিয়মিত ছাত্রী ছিলেন, সেই কলেজে যোগাযোগ করে তাঁর পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা নিশ্চিত করছেন।
মেয়েটি যে কলেজে পড়েন, সে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, ‘মেয়েটি একাদশ শ্রেণির পর দ্বাদশে আর ভর্তি হয়নি। অনিয়মিত হিসেবে পরীক্ষা দিতে পারবে কি না, কাগজপত্র দেখে বলতে পারব। তা না হলে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে পারবে।’
শিক্ষকতা করতে চান
পড়াশোনার বিষয় দিয়েই কথা শুরু করেন মেয়েটি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি যখন ছোট
ছিলাম, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মায়ের মতো লাগত। আমি তখন থেকেই ভাবতাম, বড় হয়ে শিক্ষকতা করব। এখন চাচ্ছি, ছোটবেলার ইচ্ছেটা পূরণ করব। পড়াশোনা শেষ করে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতে চাই।’
তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির দিকে ফিরে তাকিয়ে তিনি নিজ থেকেই বললেন বলছিলেন, ‘আমি আর আগের মতো ভয়ের মধ্যে নেই। ঘটনাটা ভয়ের ছিল। এর লাগি বেশি ভয় পাইছি। আমার স্বামী আমারে অভয় দিছেন। আমারে ভয়ের মধ্যে ফেলে রাখেননি। গত এক বছর আমি যা চাইছি, তা তিনি (স্বামী) দিছইন। মামলা নিয়ে অনেক ভয়ভীতি সয়েছেন। আমি এখন তাঁর পাশে থাকতাম চাই।’
পাশে থাকা স্বামী বললেন, ‘আমি যা করেছি, কাউন্সেলিংয়ের অংশ হিসেবে করেছি। এই তো এখানে আসার আগে সে (স্ত্রী) চাইছিল, বাড়ি (বাবার বাড়ি) যেতে। আমার আম্মা বলেন, আগে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে এক রাত থেকে সোজা এখানে এসেছি। তাঁর কথামতো নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছি।’
মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে মেয়েটি বলেন, ‘আমি আইনজীবীদের মাধ্যমে সবকিছু বুঝেছি। অপরাধীদের বিচার হবে এখন। আমি এমন এক বিচার চাই, যে রায় দেখে কোনো ছেলে আর কোনো মেয়ের প্রতি এমন আক্রমণ তো দূরের কথা, চোখ তুলে যেন না তাকায়। এককথায় সর্বোচ্চ একটা কঠিন শাস্তি চাই।’
বাদীপক্ষে মামলা পরিচালনায় আইনজীবী প্যানেলের প্রধান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের মিলিত প্রচেষ্টায় মেয়েটির জীবন স্বাভাবিক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। আজ তো মনে হয়েছে, তিনি খুব স্বাভাবিক, ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সেদিনের ঘটনা ও মামলার গতি
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মেয়েটি ও তাঁর স্বামী সিলেটের এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। একদল ছেলে তাঁদের গাড়ির চাবি কেড়ে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে টাকা চান। ওই ছেলেরা কলেজের ছাত্রাবাসে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।
এই অভিযোগে স্বামী বাদী হয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় দুজনকে আসামি করে ধর্ষণ মামলা করেন। আর চাঁদাবাজি মামলার বাদী ছিল পুলিশ।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির পৃথক দুটি অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান, তারেকুল ইসলাম, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ও মিসবাউল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামি রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমানকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।
আটজনই বর্তমানে কারাগারে। এখন এ ঘটনায় দায়ের করা ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মামলা দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে।
‘কনটেইনার বক্স’ স্থাপন
ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে দাবি উঠেছিল এমসি কলেজের সামনে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের। ঘটনার এক বছরের মাথায় জাতিসংঘের মিশনের আদলে টিলাগড় মোড় এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে সিলেট নগর পুলিশের প্রথম ‘কনটেইনার বক্স’।
মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার অধীন এই বক্সের কার্যক্রম ফাঁড়ি অথবা তদন্ত কেন্দ্রের মতো হবে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার বি এম আশরাফ উল্যাহ।
তিনি বলেন, মহানগর পুলিশের নতুন একটি কার্যক্রম এটি। প্রাথমিকভাবে এটি রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা হবে। পরে কার্যক্রম বাড়ানো হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ অক্টোবর ০১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,