লেখা: মো. সাইফুল্লাহ
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শেরি টারকেল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সমাজবিজ্ঞান ও ব্যক্তি মনোবিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি করেছেন। যন্ত্র এবং মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে একাধিক বই লিখেছেন তিনি। ২০১৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের সেরা ৫০ নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন টারকেল। সম্প্রতি তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে টাইম ডট কমে।
আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত সময়গুলোও ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া দখল করে নিলে কী হতে পারে, সমগ্র পেশাজীবনে এটিই ছিল আমার গবেষণার বিষয়। সব সময় পর্দা (স্ক্রিন) চালু রাখা এবং সর্বক্ষণ নিজেকে কোনো না কোনো পর্দায় উপস্থাপন করা এক দিক থেকে সুবিধাজনক। কিন্তু পর্দার দিকে তাকিয়ে আমরা একজন আরেকজনকে পুরোপুরি বুঝতে পারি না। এটা মানুষের সমানুভূতির সক্ষমতার ওপর বড় আঘাত।
কোয়ারেন্টিন ও লকডাউনের দিনগুলোর আগে আমি জানতাম, আমরা সবাই জানতাম—ফোন আমাদের নানাভাবে যুক্ত করে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি গভীর ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একরকম বাধা। কারণ, ফোন আমাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পর্দার আড়াল থেকে কথা বললে নিজের দুর্বলতাকে আড়ালে রাখা যায়। এটা আপনার কাছে ইতিবাচক মনে হতে পারে। কিন্তু এর একটা মন্দ দিকও আছে। কারণ, ঘনিষ্ঠতা তৈরির প্রথম ধাপই হলো দুর্বলতা তৈরি হওয়া।
এরপর এল মহামারি। যেই পর্দা আমাদের অর্থবহ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে বড় বাধা, হঠাৎ সেটিই হয়ে উঠল একে অপরের সঙ্গে কথা বলার একমাত্র মাধ্যম। একসময় আমি বলেছিলাম, ‘একা হয়েও আমরা এক।’ আর মহামারি আসার পর পরিস্থিতি দাঁড়াল, ‘এক হয়েও আমরা একা।’
পরিবার ও কর্মক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করে আমি বলেছিলাম, ‘আমরা তখনই নিজেদের সেরাটা দিতে পারি, যখন পর্দা থেকে মুখ তুলে আমরা মুখোমুখি কথা বলার চর্চা করি। গত এক বছর আমি নিজেই নিজের পরামর্শ মানতে পারিনি। সহকর্মী বা আমার শিক্ষার্থীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সুযোগ আমার হয়নি। সর্বোচ্চ যা করতে পেরেছি, তা হলো ল্যাপটপের ওপরের সবুজ বাতিটার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। এটা ওপাশের মানুষটাকে বিভ্রান্ত করে, একধরনের অনুভূতি দেয় যে আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এই বিভ্রান্তি ধরে রাখতে হলে আপনাকে অর্থহীন বাতিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।’
কোভিড-১৯ আসার পর আচমকা আমরা অনেকেই পরিবার ও বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর স্বস্তিটুকুকে অস্বীকার করা শুরু করলাম। সন্তান, নাতি-নাতনি বা বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে কাটানো সময়ের অনুভূতি ছিল সবচেয়ে টেকসই, অথচ রাতারাতি সেটিই হয়ে উঠল বিপজ্জনক। যে নির্জনতায় অনভ্যস্ত ছিলাম, সেটিই হয়ে উঠল জীবনের শৃঙ্খলা। ক্যাফে, বিপণিবিতান, বাড়ির পাশের রেস্তোরাঁগুলোর ওপর যে কতখানি নির্ভরশীল ছিলাম, তা এই সময়ে বুঝেছি। সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ‘থার্ড প্লেস’।
দেশকে নতুন করে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে কোভিড। এর মধ্যে কিছু ছিল ইতিবাচক: পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব, প্রতিবেশীদের ঔদার্য, ছোট ছোট সহায়তার বড়ত্ব। তবে বেশির ভাগই ছিল দুঃখজনক: পদ্ধতিগত বিভেদ আর পুলিশের সহিংসতা। আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কোভিডের ধাক্কায় এই সবই দৃশ্যমান হয়েছে।
অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, এই ধাক্কাই একটা বড় উপহার। ১৯ বছর বয়সে আমি যখন রেডক্লিফ কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী, মায়ের মৃত্যু আমাদের পরিবারকে বড় সংকটে ফেলে দিয়েছিল। আমি কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়েছিলাম। আমার নানা আমাকে আমার সৎবাবার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। তিনি আমাকে প্যারিসের টিকিট কেটে দিয়েছিলেন।
প্যারিসে এক মধ্যবিত্ত দম্পতি আমাকে থাকার জায়গা দিলেন, বিনিময়ে আমি তাঁদের ঘর পরিষ্কার করে দিতাম। তাঁরা আমাকে বলতেন ‘পর্তুগিজ’। কারণ, এ ধরনের কাজ সাধারণত পর্তুগিজ নারীরা করতেন। আমার নাম আর দেশ, দুটোই যেন হারিয়ে গেল। নতুন করে দেখার সুযোগ পেলাম। ফরাসি নৃবিজ্ঞানী ক্লড লেভি স্ট্রসের ভাষায় একে বলে দৃশ্যের পরিবর্তন বা দেশহীনতা। নৃতাত্ত্বিকেরা পরিচিত পরিবেশ পেছনে রেখে যান একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়ার জন্য। এর ফলে আপনি বুঝতে পারেন, আশপাশের সব আপনি স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলেন বলেই অনেক দমন আপনার চোখে পড়েনি।
যেহেতু মায়ের জন্য মন কাঁদত, আমি নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে শুরু করলাম। আমি শিখলাম, অন্যের কথা শোনা মানে তাঁর কথাকে ‘আমি যা শুনতে চাই’ তাতে রূপান্তর করে নেওয়া নয়। একাকিত্ব থেকেই সমানুভূতির জন্ম হয়।
এই সংকট থেকে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হলো সমানুভূতি। এর মানে এই নয় যে, ‘তোমার কেমন লাগছে আমি বুঝি।’ বরং নম্রতার সঙ্গে এটা স্বীকার করে নেওয়া যে তোমার কেমন লাগছে তা আমি কখনোই বুঝতে পারব না। অতএব তাঁকেই জিজ্ঞেস করা, ‘কেমন লাগছে? আমাকে বলো।’ কারও কথা শুনলে তিনি ভরসা পান। আর যিনি শোনেন, তিনি বড় হন। কত বেশি অন্যের কথা শোনা উচিত সেটা যখন বুঝবেন, তখন এ-ও বুঝবেন, নিজের সম্পর্কে আপনার কত কিছু জানার বাকি। (সংক্ষেপিত)
(ইংরেজি থেকে অনুদিত)
সূত্র:প্রথম আলো
তারিখ: মার্চ ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,