৫০ বছর আগে পাকিস্তানি বাহিনীর যে নির্মমতার শিকার হয়েছিল বাংলার মানুষ, এক মিনিটের জন্য বাতি নিভিয়ে সেই কালরাত স্মরণ করবে বাংলাদেশ।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারপর নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যা এ বছরই ৫০ বছর পূর্ণ করল।
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয় বাংলাদেশে। সরকারি এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, গণহত্যা দিবসে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
এ সময় সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবন ও স্থাপনায় কোনো আলোকসজ্জা করা যাবে না। তবে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে। কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনাগুলো ব্ল্যাক আউটের আওতামুক্ত থাকবে।
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তথ্যবিবরণীতে জানানো হয়েছ। কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
গণহত্যা দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘এই দিনকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের প্রতীক।’
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘একাত্তরের বীভৎস গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়। এমন গণহত্যা আর কোথাও যাতে না ঘটে, গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে সে দাবিই বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হবে।’
আলাদা বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে বিশ্বের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করি একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের, যাঁদের তাজা রক্তের শপথ বীর বাঙালির অস্ত্র ধারণ করে স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাস থেকে বিজয়ের আগপর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর বহন করছে খুনিয়াদিঘি। ক্যাম্পে নির্যাতন চালিয়ে যাদের হত্যা করা হতো, তাদের পাশাপাশি ওই দিঘির পাড়ে হত্যা করা লোকজনকেও পানিতে ফেলে দিত পাকিস্তানি সেনারা।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ক্যাম্প থেকে ১২ জনকে ধরে এনে যখন তাঁদের গুলি করা হয়, তখন সোনা বকশ আলীর ডান বুকের ওপরের দিকে একটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘির পানিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। চারদিকে ভাসতে থাকা পচাগলা লাশ আর কচুরিপানায় ঢেকে যায় তাঁর শরীর।
ওই ঘটনার পর খুনিয়াদিঘির পানির লাশের স্তূপের মধ্যে সোনা বকশকে নড়াচড়া করতে দেখে তুলে নিয়ে যায় স্থানীয় লোকজন। এরপর তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ভারতের একটি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এক মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠেন সোনা বকশ। সেই নির্যাতনের চিহ্ন দীর্ঘদিন বহনের পর আট বছর আগে তিনি মারা যান।
সোনা বকশের ছেলে গোলাম মোস্তফা জানান, তাঁর বাবা মাঝেমধ্যে খুনিয়াদিঘির ওই বর্বরতার ঘটনা শোনাতেন। তিনি বলতেন, ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন লোকজনকে চোখ বেঁধে সেনারা বাইরে নিয়ে যেত। কিছুক্ষণ পরই শোনা যেত গুলির শব্দ। যারা যেত, তারা আর ফিরে আসত না।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে উপজেলার নেকমরদ বাজার থেকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রহমানের ছোট ভাই আব্দুর সহমান বাধা দিলে তাঁকেও তুলে নিয়ে যায় তারা। রানীশংকৈল ক্যাম্পে রেখে চালাতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। নির্যাতনের পর খুনিয়াদিঘিতে নিয়ে হত্যা করা হয় তাঁদের। খুনিয়াদিঘি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার রহমান ও সহমানের ভাতিজা ঠাকুরগাঁও আইনজীবী সমিতির সদস্য আব্দুল করিম এ কথাগুলো জানান।
খুনিয়াদিঘির হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন হরিপুর উপজেলার সূর্য মোহন। এক অনুষ্ঠানে তিনি বেঁচে যাওয়ার লোমহর্ষ কাহিনি বলেন। দিঘির পাড়ে অন্যদের সঙ্গে সারি করে দাঁড় করানো হয় সূর্য মোহনকেও। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের শরীর থেকে রক্ত ঝরাতে থাকে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। আর তা উপভোগ করে অন্যরা। পরে তাদের ওপর গুলি ছোড়া হয়। গুলি সূর্য মোহনের বুকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দিঘির কচুরিপানার মধ্যে মরার মতো পড়ে থাকেন তিনি। পরে সেখান থেকে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি।
রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম বলেন, খুনিয়াদিঘিতে মোট কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তা নিরূপণের জন্য ১৯৯৭ সালের দিকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে পরে সেই কাজ বেশি দূর এগোয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং গাঢ় খয়েরি হয়ে ছিল অনেক দিন। দিঘির উত্তর দিকে পাওয়া যায় শত শত মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। ওই হাড়গোড়ের সংখ্যা দেখে অনুমান করা যায়, ১৯৭১ সালে খুনিয়াদিঘিতে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দিঘি থেকে উদ্ধার করা মানুষের হাড়গোড় একটি গর্ত করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরে ওই জায়গাটিতে স্থাপন করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৩ সালে খুনিয়াদিঘি স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন জাতীয় চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে, ‘মনে রেখ আমরা আমাদের বর্তমানকে তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য উৎসর্গ করে গেলাম।’
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: মার্চ ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,