নীতি প্রণয়নের সময় দেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা মাথায় রাখা উচিত। অর্থনীতিবিদ ও নীতিপ্রণেতাদের বুঝতে হবে, নীতি সংস্কারের সফলতা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। সেখানকার অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক, সামাজিক রীতিনীতি, আইনকানুন, প্রতিষ্ঠান—এসব কিছুই নীতি সফলতার ভিত্তি তৈরি করে। ফলে উন্নত দেশের ভালো নীতি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না–ও হতে পারে।
বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান সুশাসনের যে সূচক তৈরি করে, তা দিয়ে উন্নয়নের চরিত্র বোঝা কঠিন। সুশাসনের সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে থাকলেও গত এক দশকে প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই এগিয়েছে। অর্থাৎ সবারই নিজস্ব গল্প থাকে। কেউ কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে সফল হতে পারে না। এটা অনেকটা এ রকম—কাউকে ভালো খেলার পরামর্শ দিতে শচীন টেন্ডুলকারকে অনুকরণ করতে বলা।
পৃথিবীর সব দেশে নিজের মতো করে উন্নতি করেছে। পশ্চিম ইউরোপ একভাবে সফলতা পেয়েছে। পূর্ব এশিয়া আরেকভাবে। আবার পূর্ব এশিয়ার সব দেশ যে একইভাবে উন্নতি করেছে, তা–ও নয়। দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের হাত ধরে উন্নতি করেছে, সেখানে তাইওয়ান উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের বদৌলতে।
আজ রাজধানীর গুলশানের লেক শোর হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত জনবক্তৃতায় এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ‘মার্কেটস, মোরালস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: রিথিঙ্কিং ইকোনমিকস ফ্রম আ ডেভেলপিং কান্ট্রি পারস্পেকটিভ’ শিরোনামে তিনি এ বক্তৃতা দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
দেশে দেশে উন্নয়ন মডেলের ভিন্নতা থাকলেও একটি ব্যাপারে মিল দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সেটা হলো সরকারের সব স্তরে জবাবদিহি। গণতান্ত্রিক, কর্তৃত্বপরায়ণ, মিশ্র—যে ধরনের সরকারব্যবস্থা হোক না কেন, জবাবদিহি ছাড়া উন্নতি সম্ভব হয়নি বলেই দেখা যায়। জবাবদিহির সঙ্গে আছে দক্ষতা ও জনকল্যাণে গুরুত্ব। তিনি মনে করেন, এ দুটো বরং আরও সফলতার আরও প্রত্যক্ষ কারণ। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। আর চীনে উদারনৈতিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক জবাবদিহি ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে এ জবাবদিহির সঙ্গে কর্তব্যপরায়ণতা দরকার। কারণ, নিছক জবাবদিহি দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না। ২০২০ সালের শুরুতে তাঁর এক বক্তৃতার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ কথা বলেছিলেন বলে জানান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মত, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা থাকলেও নাগরিক সমাজের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ও স্বাধীন গণমাধ্যমের জায়গা থাকলে জনগণের মধ্যে বৈধতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য হলেও সরকারের মধ্যে কিছুটা হলেও জবাবদিহি থাকবে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তৃতার পর সারসংক্ষেপ করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে শুধু যে অর্থ ও ক্ষমতা কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তা নয়, বরং বাজারের বাইরেও যে কিছু মূল্যবোধ সমাজে থাকে, সেগুলোও নষ্ট হয়। বাজার অনেক সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে, যার কারণে একদল মানুষ আরেক দল মানুষের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিঃস্ব হয়ে যায়। অথচ তাদের কথা কেউ ভাবে না। এ পর্যায়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্ন ও মন্তব৵ করার আহ্বান জানান বিনায়ক সেন।
এ পর্যায়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তৃতার ওপর আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান। ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান।
বক্তৃতার একই শিরোনামে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ০৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,