লেখক:ফারুক ওয়াসিফ।
ঘরে আগুন লাগলে মানুষ ফায়ার সার্ভিস ডাকে। কিন্তু ক্ষুধার আগুন নেভাতে আসবে কোন ফায়ার সার্ভিস? না, নেই কোনো জরুরি সহায়তা কর্মসূচি। আছে কেবল টিসিবির ট্রাক। বিশ্ব নারী দিবসে মধ্যবিত্ত জমায়েতে আর ফেসবুক মহল্লায় বেগুনি উৎসব হয়ে গেল। শ্রমজীবী নারীরা তখন ছুটছিলেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে। একটা ছবি: ছুটন্ত ট্রাকের পেছনে ছুটেও নাগাল পাচ্ছেন না। আরেকটি ছবি: চলন্ত ট্রাকের পেছনটা ধরে ঝুলছেন এক বয়স্ক নারী। আরও মর্মান্তিক ক্রেতাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি-মারামারি। পণ্য কম, মানুষ বেশি। সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য মরিয়া নারীদের দেখে চোখে পানি চলে আসে।
এভাবেই দরিদ্র মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ধনীদের রেয়াত দেয়। মজুতদারেরা হাসেন। ভুক্তভোগীরা সব জেনেও অসহায়। তাদের ক্ষমতার হাত এতই খাটো, নিজের মতো আরেকজনের গাল বা চুল শুধু ধরা যায়, মহাজনেরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে দেশে রাজনীতিতে অচলাবস্থা, গরিব তো দুরস্ত, মধ্যবিত্তেরও সংগঠন নেই, সেখানে মুনাফার লাগাম ধরবে কে?
নারীরা যুদ্ধের শিকার হন বেশি। যখন মহামারি চলছিল, তখনো নারীরা অভাব আর নির্যাতনের চাপ বেশি সয়েছেন। যখন জিনিসপত্রের দাম আকাশে উঠে যাচ্ছে, তখনো বাজারের আগুন বেশি পোড়াচ্ছে তাঁদেরই। নারীদের এখন ঘরে-বাইরে কর্ম করে খাওয়া লাগে। গৃহিণী নামক গেরস্তালি শ্রমদানের পেশা দিয়ে আর পরিবার চলে না। পরিবারের সবাইকে রেঁধে খাওয়ানোর আগে বাজারটাও তাঁদেরই করা লাগে এখন। পুরুষদের লজ্জা লাগে বলে স্ত্রী-কন্যাদের তাঁরা টিসিবির ট্রাকের সারিতে পাঠান।
আসলে পুরুষেরা নন, লাখো দরিদ্র নারীকে খাদ্যপণ্যের জন্য রাস্তায় নামিয়েছে আর কেউ নয়, স্বয়ং সরকার। অর্থমন্ত্রী নীরব, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর কিছু করার নেই। তিনি দেখালেন আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই। চাল-তেল-আটার দাম তো বহুদিন ধরেই বাড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই এখানে খাটবে না। মুদ্রাস্ফীতি সামলানোয় কী করা হয়েছে? বাংলাদেশে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর ভারতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শুল্ক-ভ্যাট বসিয়ে দাম বাড়ানোর বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এভাবে সরকার আয় করে। এ আয়ের বড় অংশ যায় দুর্নীতিতে আর অস্বাভাবিক খরুচে উন্নয়নের খাই মেটাতে। এ আয়-ব্যয় হয় খেলাপিদের ঋণের বোঝা টানতে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পুষতে।
কেনা দামের ওপর অস্বাভাবিক লাভ ধরাই বাংলাদেশে রীতি। ওভার ইনভয়েসিংয়ের কায়দায় দুই দফায় লুট হয় সাধারণের পকেট। একবার বেশি আমদানি ব্যয় দেখিয়ে বাড়তিটা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে, পরের দফায় সেই পাচারের খেসারতটা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে তুলে নিয়ে। ধনীদের আয় বাড়ানোর বহু কলাকৌশল রাষ্ট্রই করে রাখে। সে জন্যই কোটিপতি পয়দা করার দিক থেকে বাংলাদেশ বরাবরই বিশ্বের অন্যতম সেরা দেশ। সে জন্যই মহামারির মধ্যেও বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বাড়ে।
সাবেক কালে কেউ লাখপতি হলে বাড়িতে বাঁশের খুঁটির আগায় লাখের বাতি জ্বালাতেন। আধুনিক কালের বাংলাদেশি বিলিয়নিয়াররা শতকোটির মালিক হলে বিদেশে বাতি জ্বালান। হাজার কোটিপতি হলে তারাভরা শপিং মল, বিলাসবহুল হোটেল বা প্রাসাদ কেনেন স্বপ্নের বিদেশে। আগের নিয়ম থাকলে বাংলার আকাশ মিল্কিওয়ে ছায়াপথের মতো ঝলমল করত।
এদিকে গত মঙ্গলবার দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এবং সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই গ্রেপ্তার হয়েছেন। মন্ত্রী বা তাঁদের ভাই-বেরাদরের দরকার নেই, জেলা পর্যায়ের নেতারাই যদি হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেন, তাহলে সারা দেশে এ রকম কত নেতা আছেন? কত মন্ত্রীর স্বজন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত? তাঁদের ইতিহাসটা কী? এসবের কী কুফল অর্থনীতিতে পড়ছে, কীভাবে বাজার বেসামাল হচ্ছে? প্রশ্ন অনেক এবং উত্তরও অনেকেরই জানা। তবে এভাবে চলতে পারে না। করোনা মহামারিতে মধ্যবিত্তের পিঠ বেঁকে গিয়েছিল। বেকারত্ব সীমা ছাড়িয়েছিল। এখন টিসিবির ট্রাকের পেছনে স্বল্প আয়ের বাংলাদেশকে দৌড়াতে দেখে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের মনেও ভয় জাগছে। সামনে রোজা আসছে, বাজারে দাবানল লাগানোর ভয় নিয়ে।
কোনো সাধারণ ব্যবস্থা দিয়ে বাজারের ওপর দুর্বৃত্তদের থাবা সরানো যাবে না। গত এক যুগে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে আগে অর্থ পাচারের হিড়িক বাড়ে। ২০১৪ সালে, ২০১৮ সালের মুদ্রা পাচারের পরিসংখ্যান তা-ই বলে। আগামী বছর আরেকটা নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। সরকার এবং সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে সেই পুরোনো প্রশ্নই তুলছি—ভোটের আগে ভাত মিলবে তো? উন্নয়ন তো খাওয়া যায় না।
**** ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১০, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,