লেখক: আল জাজিরা ও বিবিসি অবলম্বনে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন
উত্তর কোরিয়ায় কিম জং-উন যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর বয়স ৩০ বছরও হয়নি। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৬৯ বছর বয়সে মারা যান কিম জং–উনের বাবা কিম জং–ইল। তিনি তখন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর ওই বছর রাষ্ট্র পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন দেশটির তরুণ নেতা কিম জং–উন। পরে দেশটিতে ক্ষমতাসীন দল ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
এক দশক ধরে কঠোর হাতে উত্তর কোরিয়া পরিচালনা করছেন কিম জং–উন। ওই সময় অনেকেই আশা করেছিলেন, ইউরোপে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বয়সে তরুণ কিম জং–উন উত্তর কোরিয়ায় ব্যাপক সংস্কার আনবেন। দেশটির পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কৌশল বদলে দেবেন। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পথে অগ্রযাত্রা সীমিত করবেন। এর মধ্য দিয়ে ভাগ্য ফিরতে শুরু করবে উত্তর কোরিয়াবাসীর। তবে তাঁদের এমন প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। গত এক দশকে দেশ শাসনে কঠোর হতে পিছপা হননি কিম জং–উন।
এই বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক থিংক ট্যাংক এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের উত্তর কোরিয়া বিষয়ক রিসার্চ ফেলো গো মুয়ং–হুউন বলেন, ‘কিম জং–উনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই সবসময় ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা প্রবণতা রয়েছে। আর এজন্যই কিম জং–উনকে নিজের উত্তরসুরী নির্বাচন করে গেছেন কিম জং–ইল। এমনকি পরিবারের ছোট সন্তান হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনায় কিম জং–উন ছিলেন তাঁর বাবার প্রথম পছন্দ। ক্ষমতার প্রতি মোহ তাঁকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা বানিয়েছে।’
সামরিকায়নে গুরুত্ব
গত এক দশকের শাসনামলে কিম জং–উনের হাত ধরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এক ধাপ এগিয়ে গেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির হাতে এমন কিছু আন্ত:মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। পুরনো বিরোধের জেরে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে জড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে পৌছে গিয়েছিলেন কিম জং–উন। তিনি উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীকে বাবার আমলের চেয়েও শক্তিশালী করেছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস–এ পারমাণবিক নীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক হিসেবে কাজ করছেন অঙ্কিত পান্ডা। তিনি ‘কিম জং–উন অ্যান্ড দি বোম’ নামে একটি বই লিখেছেন। অঙ্কিত পান্ডা বলেন, ‘ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান তলোয়ার (অস্ত্র) মনে করেন কিম জং–উন। গত এক দশকে এই তলোয়ার প্রদর্শনকে অপরিহার্য মনে করেছেন তিনি।’
তবে এক দশক পরে এসে এখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো কিম জং–উনের স্বাস্থ্য নিয়ে মেতেছে। বেশ বড় একটা সময় জনগণের দৃষ্টির আড়ালে ছিলেন কিম জং–উন। এ সময় নিজের ওজন কয়েক কেজি কমিয়েছেন তিনি। উত্তর কোরিয়া বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করে। তাই দেশটি সম্পর্কে খুব একটা জানতে পারেন না বিশ্ববাসী। কিম জং–উনের প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যেটুকু জানানো হয়, সেটাই উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে বাইরের মানুষের জানার সবচেয়ে বড় উৎস। তাই কিম জং–উনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অনুমান করাও কঠিন।
রক্ষণশীল কিম জং–উন
‘আপনি যদি কারো সম্পর্কে বিশদ জানতে চান, তবে সবার আগে তাঁর পরিবার এবং শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানুন।’ কিম জং–উনের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার শেজং ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর নর্থ কোরিয়া স্টাডিজের পরিচালক চেয়ং শেয়ং–চাং। তাঁর মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে কিম জং–উনের পরিবার ছিল রক্ষণশীল। তাঁর মধ্যেও এই প্রবণতা রয়ে গেছে।
চেয়ং শেয়ং–চাং বলেন, ‘শৈশব থেকেই কিম জং–উনের মধ্যে ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা দেখা গেছে। তিনি সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত। কিম জং–উনের অষ্টম জন্মদিনের একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। সেটায় তাঁকে র্যাঙ্কযুক্ত সামরিক ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখা গেছে। পাশের সামরিক কর্মকর্তাদের তাঁকে স্যালুট দিতে দেখা যায় ছবিতে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, শৈশব থেকেই ভবিষ্যতের জেনারেল হিসেবে কিম জং–উনকে প্রস্তুত করা হয়েছে।’
একটু বড় হলে কিম জং–উনকে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। ওই বিদ্যালয়ে কিম জং–উনের বড় ভাই কিম জং–চোল পড়াশোনা করতেন। এক সময় কিম জং–চোলকে উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা মনে করা হতো। কিন্তু তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উচ্চাভিলাষের ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন চেয়ং শেয়ং–চাং। তাই কিম জং–ইলের কাছে উত্তরসুরী হিসেবে পছন্দের ছিলেন ছোট ছেলে কিম জং–উন। সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কিম জং–উন দেশে ফেরেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সাং মিলিটারি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৮ সালে সামরিক বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করেন। কিম জং–উন ঘোড়া চালাতে ও বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করেন।
বিরোধে জড়ান কিম জং–উন
২০১১ সালে রাষ্ট্র শাসনের ভার নিয়ে প্রক্রিয়াটি বুঝতে কিছুটা সময় নেন কিম জং–উন। এই বিষয়ে গো মুয়ং–হুউন জানান, তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই নিজের আসল চেহারা দেখাতে শুরু করেন কিম জং–উন। শুরুতেই তিনি রাস্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রভাবশালী সামরিক–বেসামরিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে একে হত্যা করেন। নিজের অবস্থান মজবুত করার পর তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজর দেন। উত্তর কোরিয়াকে ‘আঞ্চলিক শক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নতুন করে বিরোধে জড়ান যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০১৭ সালে নিজের সৎভাই কিম জং–নামকে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করে হত্যার গুরুতর অভিযোগ ওঠে কিম জং–উনের বিরুদ্ধে। বিশ্বে যেই অল্প কয়েকটি দেশে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস রয়েছে, মালয়েশিয়া তার একটি। এই ঘটনায় দুই দেশের কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়। এর জেরে কুয়ালালামপুরে দূতাবাস বন্ধ করতে বাধ্য হয় পিয়ংইয়ং। শুধু তাই নয়, একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোয় শিরোনাম হয়েছেন কিম জং–উন। এর জেরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর হুমকি দেয় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ২০১৭ সালজুড়ে চরম উত্তেজনা বজায় ছিল। বছরজুড়ে হুমকি–ধামকি দিয়েছিল দুপক্ষ। তবে পরের বছর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। ২০১৮ সালে কিম জং–উন প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে–ইনের সঙ্গে দেখা করেন। পরে তিনি সিঙ্গাপুরে বৈঠক করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে এসব বৈঠক ছিল নজিরবিহীন। কিম জং–উনের আগে উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেননি। এতে উত্তেজনা সাময়িক কমে আসে। শান্তির প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিম জং–উনের কূটনৈতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিচিত হয় বিশ্ববাসী।
তবে প্রত্যাশা ফিকে হতে সময় লাগেনি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতির জেরে ২০১৯ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠক বাতিল করেন কিম–জং উন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলেনি। পিয়ংইয়ং ত্যাগ করেনি অস্ত্র অর্জনের পথ। ওই সময় ট্রাম্প কিম জং–উনকে ‘ছোট রকেট’ বলে কটাক্ষ করেন। পাল্টা জবাবে কিম জং–উন ট্রাম্পকে বলেন, ‘ভীমরতিগ্রস্ত বুড়ো’। জাতিসংঘ অভিযোগ করে, ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে উত্তর কোরিয়া।
গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ায়, কিম জং–উন মারা গেছেন। সেই গুজব মিথ্যা প্রমাণ করে প্রকাশ্যে আসেন তিনি। চলতি বছর বেশকিছুদিন আড়ালে ছিলেন। ওজন কমিয়ে সম্প্রতি জনসম্মুখে এসেছেন কিম জং–উন। তিনি মনে করেন, গণবিধ্বংসী অস্ত্র অর্জন করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আর এই পথে চীন ও রাশিয়া বরাবরই তাঁর পাশে রয়েছে।
অঙ্কিত পান্ডার মতে, নিজের ঘরের পাশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি পিয়ংইয়ংয়ের জন্য ভয়ের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার জন্য জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকে। দেশ দুটি এজন্য সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। আর দেশ দুটির এমন ভয় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এটাই কোরীয় উপদ্বীপসহ এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
উত্তর কোরিয়াবাসীর দুর্দশা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধের সময় কিম জং–উন প্রমাণ করেছেন, তিনি তাঁর বাবার চেয়েও শক্তিশালী। এমনটাই মনে করছেন গো মুয়ং–হুউন। তাঁর মতে, ভুগতে হচ্ছে উত্তর কোরিয়াবাসীকে। বছরের পর বছর ধরে চলমান নিষেধাজ্ঞার জেরে দেশটির অর্থনীতি এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে চরম খাদ্যসংকট। করোনা মহামারি বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কিম জং–উনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংকটের গভীরতা হয়তো কিম জং–উন নিজেও বুঝতে পেরেছেন। তাই হয়তো তিনি বর্তমান সংকটকে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশটির ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে তুলনা করেন। ওই দুর্ভিক্ষে উত্তর কোরিয়ায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দেশটির জনগণকে ‘কঠিন সংকট’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন কিম জং-উন।
আল জাজিরা ও বিবিসি অবলম্বনে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,