সারা বিশ্বেই এখন অর্থনীতির মাথাব্যথার প্রধান কারণ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। উন্নত দেশগুলো কোভিডের প্রভাব মোকাবিলায় মানুষকে নগদ প্রণোদনা দিয়েছে। তাতে মানুষের সঞ্চয় বেড়েছে, কমেছে ঋণ। এতে কেনাকাটা বেড়েছে।
আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআইয়ের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন মনে করেন, এবারের মূল্যস্ফীতির ভিন্ন এক মাত্রা আছে। সেটি হলো শ্রমবাজারের শক্তি। এবার শ্রমিকদের মনোভাবে বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শ্রমিকেরা এখন নিম্নদক্ষতার কাজে আগ্রহী নন, বিশেষ করে যেসব পেশায় একসঙ্গে অনেক মানুষকে কাজ করতে হয়, সেসব কাজে। তাঁরা এখন ক্যারিয়ারের অগ্রগতি নিয়ে চিন্তিত।
এ পরিস্থিতিতে কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে জোগানের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়েছে। রঘুরাম রাজন বলেন, নিউইয়র্ক শহরে এখন বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের মতো। এ শহরের নিম্নদক্ষতার কাজ, অর্থাৎ যেসব পেশায় শ্রমিকদের গাদাগাদি করে কাজ করতে হয়, সেসব কাজ এখনো শুরু হয়নি। আবার অনেক জায়গায় নিয়োগদাতারা লোকের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, কিন্তু লোক পাচ্ছেন না। রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশনকারী থেকে শুরু করে ঝালাইয়ের কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সবার মধ্যেই পরিবর্তন আসছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যেটা ঘটে গেছে, সে সম্পর্কে রঘুরাম রাজন বলেন, বেশ কিছু কারণে মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতি সমর্থন করতে শুরু করেছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রঘুরাম রাজন এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে রঘুরাম রাজন আলোচনার সূত্রপাত করার পর আলোচনা করেন গীতা গোপীনাথ। তিনি বলেন, রঘুরামের ভাষ্যমতে, এবারের মূল্যস্ফীতি কত দিন বাড়তি থাকবে, সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। রঘুরাম সম্ভবত বলতে চাচ্ছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্তরের দশকের অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগে ফিরে যাচ্ছে, যার রাশ টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন ৭-৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
গীতা গোপীনাথ আরও বলেন, শ্রমবাজারে পরিবর্তনের আভাস মিলছে। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর চাপ আছে। নিম্নদক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ছে। আর করপোরেট মুনাফার পুনর্বণ্টন হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি হারে। কিন্তু এই মজুরি বাড়ার কারণে যে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে, তেমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, কোম্পানিগুলোর সেটা ধারণ করার সক্ষমতা নেই। সংকটের আগেও এটা দেখা গেছে। এবার যা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো এই মজুরি বৃদ্ধির প্রভাব পণ্যমূল্যে পড়ছে। মহামারির ধাক্কায় বিশ্ব নিশ্চিতভাবেই আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে অটোমেশন বা স্বতশ্চলীকরণের দিকে এগোবে। অর্থ আগের চেয়ে আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হবে, এর বাইরে আছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের বর্তমান গতিপ্রকৃতির কারণে বৈশ্বিক সংযোগ বরং কমেছে। প্রতিযোগিতা কমে গেছে এবং পরিণামে প্রযুক্তির স্থানান্তরের গতি খুবই কম। এসবের প্রভাব প্রকৃত অর্থেই অনুভূত হবে।
মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ মেয়াদে বাড়তি থাকবে। গীতা গোপীনাথ মনে করেন, মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর হয়তো ছোঁবে না, তবে দীর্ঘ কোনো এক সময় মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি থাকবে। আর তা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নিয়ে আসতে কঠোর নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু বাজার সেই জায়গায় আছে বলে মনে করছেন না গীতা।
২০০৭-০৮ সালে আর্থিক সংকটের পর উন্নত দেশগুলো কঠোর মুদ্রানীতির মাধ্যমে ঋণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই চাহিদা কমে যায়, যার আরেকটি কারণ হচ্ছে আয় বা সম্পদ বণ্টনে অসমতা। রঘুরাম রাজন মনে করেন, সম্পদ বিতরণে গরিবের চেয়ে ধনীর অংশীদারি বেশি হলে সমস্যা হলো, ধনীদের ভোগপ্রবণতা গরিবের তুলনায় কম। এতে বাজারে গতি আসে না। এবারের সংকটে অবশ্য ঠিক তার উল্টোটা ঘটছে বলে দেখছেন রঘুরাম—নিম্ন আয়ের মানুষের মজুরি ও আয় বাড়ছে। সমাজে দীর্ঘ মেয়াদে চাহিদা বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর যার অভাব দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার অবকাশে আছে। তবে সবচেয়ে সুখের খবর হলো, আয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সমতা আসছে, তবে একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগ
২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর দীর্ঘ সময় উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। কিন্তু এখন সম্ভবত উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতির যুগ শুরু হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হার বার্ষিক হিসাবে ৫ থেকে ১০ শতাংশের ঘরে চলে যাবে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মুদ্রানীতি বিভাগের সাবেক সদস্য চার্লস গুডহার্ট ও মর্গ্যান স্ট্যানলির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোজ প্রধান ‘দ্য গ্রেট ডেমোগ্রাফিক রিভার্সাল: এজিং সোসাইটিস, ওয়েনিং ইনইকুয়ালিটি অ্যান্ড ইনফ্ল্যাশন রিভাইভাল’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ‘যেসব কারণে বর্তমানে আমরা নিম্ন সুদহারের জমানায় বসবাস করছি, তা সম্ভবত শেষ হতে যাচ্ছে। সেই কারণগুলো হলো চীনের উত্থানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শ্রমবাজারের উত্থান, মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা হ্রাস, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন ও প্রতিযোগিতার কারণে মূল্য হ্রাস।’ তাঁরা বলেছেন, বর্তমান জমানা যে কেবল শেষ হতে যাচ্ছে, তা-ই নয়, হাওয়া বিপরীত দিকেও বইতে পারে।
আগামী ২০-৩০ বছরে চীন ও পশ্চিমা পৃথিবীতে জাপানের মতো বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অর্থাৎ যত মানুষ কাজ করবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ কর্মক্ষম মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এখন তো কোভিড-১৯-এর প্রকোপ চলছে, তার আগে থেকেই পশ্চিমা দুনিয়া এই ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ মানুষদের চিকিৎসার খরচ, পেনশন ও ভরণপোষণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
ফলাফল হিসেবে এই মহামারি সামলাতে ও বৃদ্ধ মানুষদের ভরণপোষণ দিতে দেশে দেশে ঋণের বোঝা বাড়বে। এর সঙ্গে বিশ্বায়ন বিরোধিতার পালে আরও হাওয়া লাগবে, সরবরাহব্যবস্থার সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ কারখানা নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তখন কম শ্রমিক বেশি কাজ করবে, বৃদ্ধ মানুষদের দেখাশোনার মানুষও কমে যাবে। কারখানা দেশে ফিরে এলে স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে, সেই সঙ্গে কমবে অসমতা, বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সুদহার বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু লেখকেরা বলছেন, ‘সরকার ও বেসরকারি খাতের ওপর যে পরিমাণ ঋণের বোঝা তৈরি হবে, তাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেই চাপ থেকে মুক্তি পেতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়াবে বার্ষিক ৫ থেকে ১০ শতাংশ, কোভিড-উত্তর পুনরুদ্ধারকালে আমরা সেটা দেখতে পাব।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,