সুবা বাংলার জমিদারী প্রথা সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলার সম্পদশালীদের হাতে ন্যস্ত থাকলেও ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ক্লাইভ ও সম্রাট শাহ আলমের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিদেশিদের হাতে বাংলা,বিহার,উড়িষ্যার দেওয়ানি চলে যায়।১৭৬৬ সালের ২৪ শে মার্চ জারি করা ডাক বিধি মোতাবেক বাংলার জমিদারদের ‘রানার’ যোগান দেওয়ার দায়িত্ব অর্পন করা হয় এবং যোগানের সংখ্যানুপাতে খাজনা হ্রাস করা হয়৷
লর্ড ক্লাইড জমির স্বত্বাধিকারীদের সাহায্য সর্বপ্রথম জেলা ডাকের সূচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে জমিদারি ডাক হিসেবে পরিচিতি পায়।কোম্পানি জেলা প্রশাসনের সুবিধার জন্য জেলা শহর ও প্রাদেশিক শহর দুয়ের মধ্যে চিঠিপত্র বিনা মাশুলে আদান প্রদান করা হতো।এই সময়ে কোম্পানির বণিকেরা প্রভূত ক্ষমতাশালী ও অর্থশালী উভয় দিকে শাসক হিসেবে অবতীর্ণ হন।স্থানীয় জমিদাররা তার এলাকার উপর ডাকপথ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রানার নিয়োগ,বেতন প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন যা জমিদারি খাজনা থেকেই দেয়া হতো।
জমিদাররা ডাক চলাচলের নিরাপদ ব্যবস্থা চালু রাখতে বাধ্য ছিলেন এবং কোন ধরনের ত্রুটির জন্য তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন।কাসিদ ও রানাররা শুধু ডাকব্যবস্থার সাথেই না,গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করতেন।এরা দিনে ২৫-৩০ মাইল অতিক্রম করতে পারতেন।ডি লা টশ এর বর্ননা থেকে জানা যায় রংপুর থেকে মুর্শিদাবাদ চিঠি পৌছাতে গড়ে চারদিন সময় লাগতো।দ্রুতগামী রানারদের ‘তাপ্পি’ বলা হতো৷মিরাত ই আহমাদী গ্রন্থে বলা আছে যখন নবাবী ডাক বা সরাসরি কেন্দ্রীয় ডাক বহন করা হতো তখন বাহককে দারোগা ই ডাকচৌকির স্বাক্ষরিত বিশেষ অনুমতিপত্র দেয়া হতো।একদল অনিয়মিত পুলিশ জমিদারের এলাকার অধীনে চলাচলকারী কর্মচারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়োজিত থাকতো।ব্যবসায়ী,পর্যটকদের সংবাদ বহনের জন্য ‘রাহবার’ নামে আরো এক শ্রেণীর কর্মচারীর কথা জানা যায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারী ডাকব্যবস্থা সুসংগঠিত রুপ ধারন করে।এ আইনের অধীনে সকল জমিদার,স্বাধীন তালুকদারদের বাংলা,বিহার,উড়িষ্যায় যার যার এলাকার ডাক চৌকি স্থাপন ও দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে।কিন্তু জমিদারদের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হলেও তারা এ বাবদে অর্থব্যয়ে আগ্রহী ছিলেন না।
আঠারো শতকের শেষে নিয়মিতভাবে থানা স্থাপন ও পুলিশ প্রশাসন গড়ে উঠতে থাকে।প্রকৃতপক্ষে মুঘল আমলের ফৌজদারি কেন্দ্রগুলোকে সর্বপ্রথম থানায় রুপান্তরিত করা হয়৷জমিদারদের ডাক ব্যবস্থায় উদাসীনতা ও অনিয়ম এর কারনে ১৮১৭ সালে পুলিশি ডাক ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অধীনে থানার দারোগাদের উপর ডাক পরিবহনের দায়িত্ব অর্পিত হয়।সেসময় সুবা বাংলায় বেসরকারি পর্যায়ে আরেকটি ডাক গড়ে ওঠে।এই ডাকব্যবস্থার উদ্যোক্তা ছিলেন বণিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তবে মূলত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকেই এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
কোম্পানির ডাক ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় ও জমিদারদের উদাসীনতার কারনে বণিকসমাজই সুংগঠিত ডাকব্যবস্থা গড়ে তোলে।বেসরকারি ডাকব্যবস্থা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য,সুসংগঠিত হওয়ার কারনে তা অচিরেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।এই বেসরকারি ডাকব্যবস্থার কারনে এক সময় কোম্পানির ডাকব্যবস্থা লোকসানের মুখে পড়তে শুরু করে যার ফলে কোম্পানি সরকার ১৮৩৮ সালে এ ব্যবস্থা বন্ধের জন্য নির্দেশ জারি করে।এই নির্দেশের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর একচেটিয়া ডাকব্যবস্থার অধিকার ব্জায় থাকে। বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান বা জমিদার,ব্যবসায়ী এর সাথে জড়িত থাকলে ৫০ টাকা জরিমানা সহ সর্বোচ্চ ২২ মাস পর্যন্ত জেল হতে পারতো।
দ্রুততা,নির্ভরশীলতা,নিরাপত্তা সব দিক থেকে বেসরকারি ডাক অনেক বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং জনগন অনেক বেশি মাত্রায় এর উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে।তবে বেসরকারি ডাক ব্যবস্থায় ও পরিচালকরা মুনাফালোভী হয়ে ওঠে এবং কোম্পানির আইন জারির পরেও তা বহুকাল যাবত টিকে থাকে।অবশেষে ১৮৫৪ সালে সর্বভারতীয় ডাক টিকিটের প্রবর্তন ও সারা দেশে একই ব্যবস্থা,একই নীতি,একই নিয়ম প্রচলনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জমিদারি ডাকব্যবস্থা কোম্পানি আমলের এক গুরত্বপূর্ন অধ্যায়।এই নিয়ে ততটা গবেষণা এখনো হয়ে ওঠে নি। এই নিয়ে আরো বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে৷
তথ্যসূত্রঃ
১/সুবে বাংলার জমিদার ও জমিদারী (১৭০৭-৭২), শিরিন আখতার,দিব্য প্রকাশ,ঢাকা,২০১৮,(পৃষ্ঠাঃ১৩২-১৩৫)।
২/বাংলার জমিদার ও রায়তের কথা,কমল চৌধুরী,দে’জ পাবলিশার্চ,কোলকাতা,(পৃষ্ঠাঃ৩৯৪)।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,