সত্তর বছর বয়সি মৎস্যজীবী সনাতন হালদার দাঁড়িয়ে ছিলেন রূপনারায়ণের সামনে । জল মাপছিলেন চোখের আন্দাজে । এই ভাবেই জল মেপে তিনি বুঝতে পারেন , নদী ভিতরে ভিতরে তৈরি হচ্ছে ইলিশের জন্য । মধুগুলগুলি বৃষ্টি নামল । ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিরই একটা রকমফের । এই বৃষ্টির পর ইলিশেরা উতলা হয়ে হঠে । প্রকৃতির এই ভাষা জানেন সনাতন হালদার । এই অধিবিদ্যা তার বাপ-ঠাকুরদার থেকে পাওয়া । মামারা থাকতেন সুন্দরবনে । ছোটবেলায় মামারবাড়ির দেশে বেড়াতে গেলে , দাদু নিয়ে যেতেন তাকে , ইলিশ ধরতে । কখনও নৌকো , কখনও ট্রলারে । দাদুই বলতেন , ইলিশ ধরতে গেলে জলের মন বুঝতে হয় , জলের গায়ের গন্ধ নিতে হয় ।
ইলিশ একা একা থাকতে পারে না । সপরিবার বেঁধে বেঁধে থাকে । ছোট-বড় সকলেই । মামাবাড়ির দাদু বলতেন ,
‘ গন্ধঝাঁক ’ । ইলিশরা এক সঙ্গে থাকলেই , জলের উপর দিয়ে একটা আলাদা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে । তখনই বোঝা যায় ইলিশের ঝাঁক আছে নদীর বুকে । আর জলের মন পড়তে গেলে চিনতে হয় জলের রং । তার আবার নানা নাম । ডাব জল , গাব জল , মাছ ধোয়া জল , চখা জল , কালো জল , চেরটা জল । চখা জল চোখের জলের মতো পরিষ্কার । আর চেরটা জলে থাকে অনেক শেওলা । সব জলেই কিছু না কিছু ইলিশ থাকেই । তবে ঘোলা জলে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ।
স্মৃতিগুলো ঝাঁকিয়ে নিয়ে , পাড়ের বাঁধের উপর থেকে নামলেন , চরের উপর রাখা নৌকোর কাছে । এই নৌকো করেই প্রতি বার তিনি ইলিশ ধরতে যান । ভালবেসে নৌকোটার নাম দিয়েছিলেন ‘ সোহাগী ’ । ইলিশ মাছ ধরতে , এই আদরের নৌকোই তাঁর সঙ্গী । এ বার পৃথিবী কিছু দিনের জন্য বন্ধ ছিল । যারা পৃথিবীটাকে শাসন করত , তারা করোনা আতঙ্কে এখন ঘরবন্দি রেখেছে নিজেদের । তাই একটু দেরি হয়েছে বেরতে । আখেরে তাতে লাভই হল । ইলিশ নিজেকে আরও সুস্বাদু করে তুলল ।
‘ মাইগ্রের ’ একটা ল্যাটিন শব্দ , যার মানে ভ্রমণ । ইলিশ মাছ ভ্রমণপ্রিয় , তাই একে বলে মাইগ্রেটরি ফিশ । কিছু দিন সাগরে , তো কিছু দিন নদীতে । নোনা জলের দেশে থাকে ইলিশ । ওটা তার শ্বশুরবাড়ি । সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে বাপের বাড়ি আসতে হয় । মিষ্টি জলের নদী ইলিশের বাপের বাড়ি । ইলিশের মা হল গঙ্গা আর মাসি পদ্মা । বছরে দু’বার বর্ষা আর শীতে , ডিম ফুটিয়ে সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে আসতে হয় বাপের বাড়ি মা-মাসির কাছে । ঝাঁক বেঁধে সমুদ্র থেকে যখন ওরা ঢোকে নদীর বুকে , তখন তাকেই বলে অ্যানাড্রোমাস পরিযাণ । গঙ্গা , রূপনারায়ণ , ব্রহ্মপুত্র , গোদাবরী , নর্মদা , তাপ্তী , পদ্মা , যমুনা , মেঘনা , কর্ণফুলি , ইরাবতী সবেতেই সাগর উজিয়ে ইলিশ আসে ।
গঙ্গা, পদ্মা উজিয়ে যে ইলিশ আসে , তাকে ইলিশ বললেও অন্য নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলে , তার আর ইলিশ নাম থাকে না । সৈয়দ মুজতবা আলী ‘ পঞ্চতন্ত্র ’ – এ লিখছেন , নর্মদা উজিয়ে যে ইলিশ আসে , ভৃগুকচ্ছের মানুষের কাছে তা ‘ মদার ’ । পার্সিদের কাছে তার নাম
‘ বিম ’ । সিন্ধু নদ উজিয়ে এলে ওই মাছের নাম ‘ পাল্লা ’ । তামিলরা ইলিশকে বলে ‘ উলম ’ । গুজরাতিরা পুরুষ ইলিশকে বলে ‘ পালভো ’ , স্ত্রী ইলিশকে বলে ‘ মোদেন ’ । তা ছাড়াও ইলিশের আরো অনেক নাম আছে : খয়রা ইলিশ , গৌরী ইলিশ , চন্দনা ইলিশ , গুর্তা ইলিশ , সকড়ি ইলিশ , জাটকা ইলিশ , ফ্যাসা ইলিশ , খ্যাপতা ইলিশ , মুখপোড়া ইলিশ এমন নানা রকম । বাংলাদেশে যে ইলিশ বিলে পাওয়া যায় , তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ বিলিশ ’ ।
অন্য মাছের তুলনায় ইলিশের কৌলীন্য বেশি । সাহিত্যিক শঙ্করের কথায় মৎস্য সমাজে ইলিশই হলো একমাত্র উপবীতধারী । তার দু’পিঠে যে দুটো সুতো থাকে , তার নাম পৈতা । আজ থেকে প্রায় ন’শো বছর আগে জীমূতবাহন তাঁর ‘ কালবিবেক ’ গ্রন্থে এই বিখ্যাত মাছটির নাম দিয়েছিলেন ইলিশ । আর ১৮২২ সালে মৎস্যবিজ্ঞানী হ্যামিলটন সাহেব এই মাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম দিলেন , হিলসা হিলসা । ১৯৫৫ সালে এই মাছের বিজ্ঞানসম্মত নামটি পাল্টে হল টেনুয়ালোসা হিলসা । এই
‘ টেনুয়ালোসা ’ শব্দটি ইলিশেরই উপযুক্ত । শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ টেনিয়াস ’ থেকে , যার অর্থ পাতলা বা স্লিম । ঝরঝরে চকচকে পাতলা শরীরের সুন্দরীর এমন নাম বেশ মানানসই ।
যা কিছুই সুন্দর , তাতে কাঁটা থাকে । যেমন গোলাপ । ইলিশ-সুন্দরীর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার । তার পেটের কাছের কাঁটা দেখে প্রজাতি ঠিক করা হয় । এই কাঁটাগুলো দেখতে ইংরেজি v অক্ষরের মতো । যাকে স্কুট বলা হয় । এই স্কুটের সংখ্যা অনুযায়ী ইলিশের প্রজাতি পাঁচ রকম । ইলিশের আবার বহুরূপী আছে । ইলিশ-সুন্দরীর মতো দেখতে হলেও স্বাদে-গন্ধে তারা কিন্তু ইলিশ নয় । যেমন , চাপিলা মাছ এবং কই-পুঁটি ।
ঘটি আর বাঙালদের মধ্যে চিরকালের এক লড়াই ইলিশ নিয়ে । বলা ভাল , ইলিশের স্বাদ নিয়ে । সমুদ্রে থাকার সময় ইলিশের শরীর ছোট , পাতলা আর কম স্বাদের হয় । নোনা জলের সংসার থেকে মিষ্টি জলের ঢোকার সময় থেকে ইলিশ পুষ্ট হতে থাকে । তার স্বাদ বাড়তে থাকে । আর লকডাউন ইলিশকে আরও একটু বেশি স্বাদ দিল । লকডাউনে নদীগুলো জলের গুণমান ফিরে পেয়েছে । গঙ্গাও অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে দূষণ । ইলিশ যে সব খাবার খেয়ে বাঁচে , তারা হল নীল-সবুজ শেওলা , কোপেপড , ক্লাদকেরা , রেটিফারের মতো জলে মিশে থাকা খাবার l নদীর জল ভাল হওয়ায় , নদীর জলে মিশে থাকা খাবারও উন্নত হয়েছে ।
ভাল মানের খাবার খেয়ে ইলিশের স্বাদ বাড়বে , এটাই মৎস্যবিজ্ঞানীদের মত । ইলিশ নদীর যত গভীরে যায় , তত খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয় । তখন সে তার শরীরে জমে থাকা ফ্যাট থেকে শক্তি সংগ্রহ করে । ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ কমতে থাকে । আর ইলিশ নরম এবং সুস্বাদু হয়ে ওঠে । এ ছাড়াও মাছের শরীরে কিছু ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্ম হয় ও তার নানা রূপান্তর ঘটে । এর ফলেও বাড়ে ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ ।
( একটি সংগৃহিত পোষ্ট )
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ১০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,