চীনের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইরান ও সৌদি আরব। বেইজিংয়ে বৈঠক শেষে এ ঘোষণা দেন সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান আলী শামখানি। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির সেন্ট্রাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই। বেইজিং, চীন, ১০ মার্চ।
দীর্ঘদিনের বিরোধের পর কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইরান ও সৌদি আরব। এ দুই দেশের সম্পর্কের উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বাড়িয়েছে, গভীর করেছে ইয়েমেন ও সিরিয়া সংঘাত। গতকাল শুক্রবার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে রাজি হয় দেশ দুটি। এতে মধ্যস্থতা করেছে চীন। দেশটির রাজধানী বেইজিংয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরাশক্তি দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তার বৈঠকের পর এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দেশ দুটির বিরোধের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নিয়েই এ প্রতিবেদন।
২০১১: আরব বসন্ত
এ বছর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন গণতন্ত্রপন্থীরা। এ সময় সৌদি আরব অভিযোগ করে, বাহরাইনের রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উসকানি দিয়েছে ইরান। বিক্ষোভ দমনে বাহরাইনে সহস্রাধিক সেনা পাঠায় সৌদি আরব। ইরান অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০১১: সিরিয়া যুদ্ধ
২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ইরান-সৌদি আরব আবার মুখোমুখি অবস্থান নেয়। শিয়া মুসলিম–অধ্যুষিত ইরান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দেয়। সরকারবিদ্রোহী সুন্নিদের বিরুদ্ধে আসাদ বাহিনীর হয়ে লড়তে সেনাসদস্য ও অর্থ সহায়তা দিতে শুরু করে ইরান। অন্যদিকে, সুন্নি মুসলিম–অধ্যুষিত সৌদি আরব সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেয়। এরপর ২০১৪ সালে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-বিরোধী জোটে যোগ দেয়।
২০১৫: ইয়েমেন যুদ্ধ
২০১৫ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সৌদি আরব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারকে সমর্থন দেয়। সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। বিশেষত, সরকারবিরোধী হুতিদের শক্ত অবস্থান আছে—এমন এলাকায় হামলা চালায়। এদিকে হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে শুরু করে ইরান।
২০১৫: মক্কায় পদদলনে মৃত্যু
এ বছর হজের সময় মক্কায় পদদলিত হয়ে হজ করতে যাওয়া বহু মুসল্লির মৃত্যুর ঘটনায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে আবারও উত্তেজনা বাড়ে। ইরানের অভিযোগ, মুসলিম তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই জমায়েত (হজ) ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সৌদি আরব। সেবার পদদলিত হয়ে হজ করতে যাওয়া প্রায় দুই হাজার মুসল্লির প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে চার শতাধিক মুসল্লি ছিলেন ইরানের নাগরিক। এ জন্যই মূলত দেশ দুটির মধ্যে বিরোধ নতুন করে বাড়তে শুরু করে।
২০১৬: সৌদি আরবের সম্পর্ক ছিন্ন
মক্কায় পদদলিত হয়ে কয়েক হাজার মুসল্লির মৃত্যুর ঘটনার চার মাস সৌদি আরব প্রখ্যাত শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এই শিয়া নেতা ছিলেন সৌদি সরকারের একজন সমালোচক। এর প্রতিবাদে তেহরানে সৌদি আরবে দূতাবাসে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি নিমরের মৃত্যুদণ্ডের জন্য ‘ঐশ্বরিক প্রতিশোধ’ সম্পর্কে সতর্ক করেন। এরপরই সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে।
২০১৬: ইরানের হজ বর্জন
একই বছর ইরান তাদের নাগরিকদের হজে অংশগ্রহণ বন্ধ করে। এ ঘটনার পর সৌদি আরব হজের প্রচারের জন্য একটি ফারসি ভাষার টেলিভিশন চালু করে। রিয়াদ জানায়, ২৪ ঘণ্টার এ স্যাটেলাইট চ্যানেল মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে হজের আনুষ্ঠানিকতা ও সব ইবাদতের বিষয়ে প্রচার চালাবে। খামেনি সৌদি আরব কীভাবে হজ পরিচালনা করছে, তা নিয়ে নিন্দা জানান এবং মুসলিম দেশগুলোকে পবিত্র হজের ওপর রিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ইতি টানার বিষয়ে চিন্তা করারও পরামর্শ দেন।
২০১৭: কাতার অবরোধ
এ বছরের জুনে সৌদি আরব তাদের মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরকে নিয়ে কাতারের ওপর একটি অবরোধ দেওয়ায় শুরু হয় আঞ্চলিক এক সংকট। কাতারের বিরুদ্ধে জল, স্থল ও আকাশপথে এ অবরোধ আরোপ করে সৌদি ও তার মিত্ররা দাবি করে, কাতার ইরানের মতোই এবং দেশটি সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। কাতার অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
২০১৭: ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে রিয়াদ
২০১৭ সালের নভেম্বরে রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশসীমায় একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে সৌদি আরব। রিয়াদ অভিযোগ করে, ক্ষেপণাস্ত্রটি রিয়াদের সরবরাহ করা এবং ইয়েমেনে হুতি–নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এটি ছোড়া হয়। সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনকে বলেন, ‘ইরানের কর্মকাণ্ড সৌদির বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল।’
২০১৭: লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
এ বছরের নভেম্বরেই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি আচমকা পদত্যাগ করেন। রিয়াদের কাছে তাঁর এভাবে পদত্যাগ ছিল অপ্রত্যাশিত। হারিরির অভিযোগ, হিজবুল্লাহর মাধ্যমে ইরান তাঁর দেশ দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পরে অবশ্য তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন। হারির পদত্যাগের এ ঘোষণা ও তা প্রত্যাহার করা লেবাননকে একটি রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দেয়। এ পদক্ষেপকে লেবাননে ইরানের প্রভাব প্রতিহত করতে সৌদির একটি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দেখা হতো।
২০১৮: ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া
২০১৮ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিল সৌদি আরব ও ইসরায়েল। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে বলেন, ‘ইরান একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে এরপর যত দ্রুত সম্ভব আমরাও তা করব।’ একই সঙ্গে খামেনিকে ‘নয়া হিটলার’ বলেও মন্তব্য করেন।
২০১৯: সৌদি আরবে হামলা
এ বছর সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থাপনায় একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সৌদির জ্বালানিশিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এক স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটে। এতে সৌদি আরবের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। এসব হামলার জন্য ইরানকেই দোষারোপ করে সৌদি আরব। সৌদি আরবের এমন অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করে ইরান। তবে ইয়েমেনের সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী সৌদি আরবে হওয়া এসব হামলার দায় স্বীকার করে।
২০২০: কাসেম সোলাইমানি হত্যা
এ বছরের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানি নিহত হন। সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জেনারেল। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
২০২১: ইরান ও সৌদি আরবের আলোচনা শুরু
২০২১ সালের এপ্রিলে ইরান ও সৌদির প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেন। মধ্যস্থতা করে ইরাক। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরে দুই দেশের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম বৈঠক।
২০২২: আরও আলোচনা
গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা চার দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করে ইরাক নয়তো ওমান। পঞ্চম দফায় আলোচনার পরই খামেনির একজন শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টা পুনরায় ইরান ও সৌদি আরবের দূতাবাস পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান। এরপর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সৌদি আরবের শাসক হিসেবে বিবেচিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করতে সৌদি আরব সফর করেন।
২০২৩: সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ঐকমত্য
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গত ফেব্রুয়ারিতে চীন সফর করেন। বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এর এক মাস পর গতকাল বেইজিংয়ে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির মধ্যকার বৈঠক শেষে আবার সব ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিল সৌদি আরব ও ইরান।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:মার্চ ১১, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,