Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

ইভানার মিসেস ব্যারিস্টার হওয়ার কাহিনি (২০২১)

Share on Facebook

লেখক: রুমিন ফারহানা।

ইভানা আমার ছাত্রী ছিল। চিনেছেন তো ইভানাকে? ওই যে মেয়েটি ১৫ সেপ্টেম্বর নয়তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে! ফরসা, কোঁকড়া চুলের ছোটখাটো পুতুলের মতো একটা মেয়ে, আমি বলতাম অ্যাঞ্জেলিক ফেস। বাঙালি উপমায় একেই বোধ হয় বলে ‘ফুলের মতো’। কথা বলত কম। যেটুকু বলত, তাও খুবই কোমল স্বরে, নিচু গলায়। আমি ভীষণ স্নেহ করতাম, কারণ ছাত্রী হিসেবে ছিল অতি মেধাবী।

অনার্স শেষ বর্ষের ক্লাস নিতাম আমি। এই বর্ষেই সবাই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য আবেদন করে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে দেখতে কে কোন বার স্কুলের অফার পেল, তিন বছর যে স্বপ্ন নিয়ে তারা পথ চলে, শেষ বর্ষ হলো তা পূর্ণতা লাভের বছর। আমরা, শিক্ষকেরাও এ সময় তাদের মতোই টেনশনে থাকতাম। বার স্কুলে আবেদন নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত, দেখি বিষণ্ন মুখে চুপচাপ ইভানা। ক্লাসের অতি মেধাবীদের একজন সে। তাই শিক্ষক হিসেবে সংগত কারণেই ডেকে প্রশ্ন করলাম, কোথায় কোথায় আবেদন করছে সে। চাপা কষ্টের গলায় জানাল, ব্যারিস্টারি পড়তে যেতে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি আছে পরিবারের।

ব্যারিস্টার হওয়ার লক্ষ্যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স যেখানে পড়ানো হয়, সেখানে মোটামুটি বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরাই আসে। ইভানাও তার ব্যতিক্রম নয়। সে নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে আসা মেয়ে। তাহলে সমস্যা কোথায়? তিন বছর যে স্বপ্ন নিয়ে মেয়েটি পড়ল, ভালো রেজাল্ট করল, তার সব বন্ধু যখন স্বপ্ন দেখছে লন্ডন যাওয়ার, ব্যারিস্টার হয়ে ফেরার, তখন পুতুলের মতো মেয়েটি বিষণ্ন মুখে কখনো ক্লাসে, কখনোবা লাইব্রেরিতে, কখনো ক্যানটিনের কোনায়। আমি কথা বলতে চাইলাম পরিবারের সঙ্গে। সে জানাল, লাভ হবে না। ও এতটাই ‘লক্ষ্মী’ ছিল যে একবার ‘না’ শোনার পর পরিবারের সঙ্গে তর্ক করা, তাদের বোঝানো ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। তাই বার করতে যাওয়া নিয়ে বন্ধুদের হইহট্টগোল, উত্তেজনা আর টেনশনের মধ্যে বিষণ্ন ইভানা আরও বিষণ্ন হয়ে রইল। ইভানার ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্নের সেখানেই ইতি।

একদিন শুনলাম ইভানার বিয়ে। ছেলে ব্যারিস্টার, খুব ভালো চিনি, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা। ভালো ছাত্র, সামাজিক মানদণ্ডে ‘ভালো পরিবার’—এই যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। আমাদের সমাজে মেয়ের বিয়ে দিতে এটুকুই তো যথেষ্ট। মানুষ কেমন, সেসব খোঁজ আর কে কবে করেছে? যা–ই হোক, বিয়ের পর ইভানার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না আমার। কোনো চেম্বারে কাজ করেছে বলেও শুনিনি। অনুমান করি, ভালো ছাত্রী হওয়ার মতোই ‘ভালো স্ত্রী’ আর ‘ভালো মা’ হওয়ার প্রতিই পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিল সে।
বিজ্ঞাপন

ইভানা লিখেছিল, ‘সম্ভাব্য তালাকের চিন্তায় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার মা-বাবা সহ্য করতে পারবেন না। তাঁদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম শারীরিক জটিলতা আছে।’

ইভানার মৃত্যুর বীভৎসতা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। যেহেতু একই কমিউনিটিতে চলাফেরা আমাদের, তাই বন্ধু, সহকর্মী, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যা জানতে পারলাম, তা হলো বিয়ের অল্প কিছুদিন পর থেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকে ইভানা। একই রকম তথ্য দেখলাম ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, যেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৮ সালে ইভানা তার এক সাবেক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত আসেনি। ২০১৫ সালে সেই শিক্ষককে পাঠানো এক লম্বা ই–মেইলে ইভানা জানায়, স্বামী তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান (ইভানার স্বামী) তাঁকে তালাকের কথা বলছেন। কিন্তু এতে তার (ইভানা) পরিবার ছোট হয়ে যাবে। তার একটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান আছে। আর যে টাকা সে রোজগার করে, তাতে দুটো সন্তানকে নিয়ে চলতে পারবে না।

মৃত্যুর দুদিন আগে একই শিক্ষককে পাঠানো বেশ কিছু খুদে বার্তায় ইভানা তার স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়ানোর কথা জানায়। এমনকি সে এটাও বলে যে তার স্বামীর পরিবার বিষয়টি জানে এবং তারা ইভানার চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। ইভানার ধারণা ছিল তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি তাকে বের করে দেওয়ার কথা সিরিয়াসলি ভাবছে।

বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথনের একটিতে ইভানা লিখেছিল, ‘সম্ভাব্য তালাকের চিন্তায় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার মা-বাবা সহ্য করতে পারবেন না। তাঁদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম শারীরিক জটিলতা আছে।’

ইভানার এই পরিণতি হওয়ার কথা ছিল না। রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা নিদেনপক্ষে শ্বশুরবাড়ি নারীর পাশে দাঁড়াবে বা অন্ততপক্ষে নারীর প্রতি মানবিক হবে—এ আশা আমি করি না। কিন্তু তার নিজের পরিবার? যেহেতু ভীষণ রকম নারীবিদ্বেষী সমাজ আর রাষ্ট্রে আমাদের মেয়েদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাই তার বেঁচে থাকার জন্য সর্বক্ষেত্রে পরিবারকে পাশে পাওয়া ভীষণ জরুরি। অতি শৈশবে শিশুর ভেতরে যা গেঁথে দেওয়া হয়, পরবর্তী সময়ে সেটাই তার ব্যক্তিত্ব, জীবনবোধ, মন–মানসিকতা ও চিন্তার ধারা তৈরি করে দেয়। পরবর্তী সময়ে যার প্রভাব পড়ে জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে।

খুব ছোটবেলা থেকে নিজের দায়িত্ব, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে আমাকে শেখানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত সব সময় সঠিক হয়েছে কিংবা পরিবারের মনের মতো হয়েছে, তেমন হয়তো নয়, কিন্তু ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গোনার জন্য আমাকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়নি। নন-জাজমেন্টাল একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা এক কন্যাশিশুর অন্য রকম শক্তি থাকে। শক্তি থাকে বৈরী চারপাশকে শক্তভাবে মোকাবিলার, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর, মাথা উঁচু করে বাঁচার।

পাঠ্যবই বা পুথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে জীবনবোধ গঠনের আপ্তবাক্য ক্রমাগত এমনভাবে আমার বাবার মুখে শুনেছি যে এর বাইরে গিয়ে জীবনকে দেখার কোনো সাধ্যই আমার ছিল না। আমি রেজাল্ট কী করছি, কোন ক্লাসে পড়ছি, নিয়মিত পাঠ্যবই নিয়ে বসছি কি না, সে বিষয়ে আমার মা–বাবাকে কখনো চিন্তিত মনে হয়নি। তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রম তাঁরা দিয়েছেন আমার জীবনবোধ তৈরিতে। যে বাক্য আমি বাবার মুখে সারা জীবনে সবচেয়ে বেশিবার শুনেছি, সেটি হলো, ‘আমি ভীরু মেয়ে চাই না, সাহসী মেয়ে চাই’। বলতেন, ‘শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালাতে হবে।’ ‘সাহস’ আর ‘লড়াই’ আমার মগজের গভীরে প্রথিত দুই শব্দ, যা আমি পরিবার থেকে পেয়েছি। আমার জীবন গঠনে এর চেয়ে বড় ভূমিকা আর কিছুরই ছিল না।

মা হয়তো আমার সামনে ক্রমাগত এমন কথা বলে যাননি, কিন্তু তাঁর জীবনটাই ছিল একটি শিক্ষা। উচ্চশিক্ষিত, স্বাধীন, সচ্ছল, ক্ষমতাবান, উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা নারীকে ২৪ ঘণ্টা চোখের সামনে দেখাও অবচেতনে সাহসী জীবনবোধ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। আমি ভাগ্যচক্রে এই পরিবারে জন্মে গেছি, স্রেফ ভাগ্যচক্রে। আমি আশা করি না, ঘরে ঘরে আমাদের কন্যারা এই পরিবেশ পাবে, যা তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই সমাজের উপযোগী করে তুলবে। আর সে কারণেই পরিবারকে বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে মেয়েদের গড়ে তোলার কথা বলছি। বর্তমানে অনেক মা–বাবাই তাঁদের কন্যাসন্তানের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগী, কিন্তু এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। একটা নারীবিদ্বেষী, নারীর প্রতি সহিংস সমাজে শক্তিশালী, স্বাধীনচেতা, সাহসী, দায়িত্ব গ্রহণে পারদর্শী ও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নারী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা আমার কাছে অনেক বেশি দরকারি মনে হয়। প্রয়োজন প্রতিটি ছেলে–মেয়েনির্বিশেষে আরেকটি জরুরি শিক্ষা—কোনো পরিস্থিতিতে, কোনো অবস্থায় আত্মহত্যা সমাধান নয়।
বিজ্ঞাপন

ইভানা মেধাবী ছাত্রী ছিল। একজন সফল ব্যারিস্টার হওয়ার সব রকম যোগ্যতা ছিল তার। কেবল একজন মিসেস ব্যারিস্টার হয়ে জীবন কাটানোর পরিণতি ভোগ করার কথা ছিল না।

কিছুদিন আগে এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ভীষণভাবে আলোচনায় আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা, সমাজের চোখে তাঁর দোষত্রুটি—সবকিছু সরিয়ে রেখে যা নজর কেড়েছিল, তা হলো সবকিছুর পরও তাঁর অদম্য সাহস, মাথা উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে হাঁটা। তাঁর এই শক্তির উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি একটি চিঠির উদ্ধৃতি দেন, যেখানে তাঁর পরিবারের একমাত্র সদস্য লিখেছেন, ‘নানু, আমি ভালো আছি। কোনো চিন্তা করবা না। তোমার সঙ্গে শিগগিরই দেখা দেব।’ এটাই পরিবারের শক্তি। না, অতি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের কেউ নয় তারা, কিন্তু পারিবারিক শক্তির মৌলিক শিক্ষাটা তাদের আছে। এই শিক্ষাটা ভীষণ জরুরি।

ইভানা মেধাবী ছাত্রী ছিল। একজন সফল ব্যারিস্টার হওয়ার সব রকম যোগ্যতা ছিল তার। কেবল একজন মিসেস ব্যারিস্টার হয়ে জীবন কাটানোর পরিণতি ভোগ করার কথা ছিল না। ইভানা খুব চিন্তিত ছিল একা দুই সন্তানকে বড় করা নিয়ে। সে লিখেছিল, ‘যখন আমি এটা লিখছি, তখন আমার জন্য নিশ্বাস নেওয়ায় কঠিন হয়ে উঠেছে। একা জীবনের জন্য আমি এখনো নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি। আমি এখনো আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত না।’ ইভানার এই দ্বিধা তাকে জীবন দিয়ে শোধ করতে হয়েছে। তার এই দ্বিধার জন্য সমাজ ও আমাদের মানসিকতার পাশাপাশি পরিবারের বড় দায় রয়েছে, যারা তাকে স্বনির্ভর, শক্ত মানুষ হিসেবে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

যেকোনো পরিস্থিতিতে পরিবারকে পাশে পাওয়া প্রত্যেক ছেলেমেয়ের অধিকার। কিন্তু কন্যাসন্তানকে যেহেতু প্রতিমুহূর্তে সমাজ, রাষ্ট্র, চেনা–অচেনা সবার বিদ্বেষ, বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়, তাই পরিবারের প্রয়োজন তার কয়েক গুণ বেশি। সেখানে সে মনখুলে কথা বলতে পারবে, অন্তত সংকটের সময় কেউ তার বিচার করতে বসবে না। এমনিতেই নারীবিদ্বেষী সমাজ, রাষ্ট্রের চাপ আছে নারীর ওপর, মা–বাবার ঘর যেন আর একটি চাপ তৈরি না করে। আর কাউকে পাশে না পাক নারী, অন্তত জীবনের প্রথম ঘরটি যেন অচেনা না হয়ে যায়। শক্তি ও সাহসের উৎস যদি নাও হতে পারে, নিদেনপক্ষে কপাটটা যেন বন্ধ না করে।

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২২, ২০২১

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ