লেখক: আদর রহমান।
ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার। নিজের লিংকডইন প্রোফাইল থেকে বিভিন্ন সময় তিনি ক্রিকেট, ক্যারিয়ার ও তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে লেখালেখি করেন। ক্যারিয়ার ও জীবনে ভালো করার কৌশলসংক্রান্ত এ লেখাও পাওয়া গেল তাঁর লিংকডইনের ব্লগে।
জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আমি একটা বিষয় খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। সেটি হলো আমাদের শেখার কোনো বয়স নেই। জীবনে এখনো যে কত কিছু শেখার বাকি!
গত সপ্তাহে ন্যাশনাল একাডেমি অব কাস্টমস, ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড নারকোটিকসের (এনএসিআইটিএন) একদল তরুণ প্রশিক্ষণার্থীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। সে সময় তাঁদের কাছ থেকে কিছু দারুণ বিষয় জেনেছিলাম। সেই আলাপচারিতার কিছু অংশ আপনাদেরও শোনাতে চাই। এ কথাগুলো আমার ব্যক্তিজীবন ও ক্যারিয়ারে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাশা করব, এ কথাগুলো আপনাদের জীবনকেও ইতিবাচকভাবে বদলে দেবে।
১. অহংবোধ ত্যাগ করুন
জীবনে এমন অনেক অর্জনের মুহূর্ত আসবে, যা অহংবোধকে উসকে দেবে। কিন্তু ওই অর্জনের মুহূর্ত থেকে শুধু সেই নির্যাসটুকুই নিতে হবে, যেটুকু আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহায়ক। সাফল্যের কারণে যদি একবার ‘আমিত্ব’ পেয়ে বসে, তাহলে জীবনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। অহং মানুষকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল দিকে নিয়ে যায়। তাই খেলার মাঠ হোক, কোনো প্রতিযোগিতা হোক বা জীবনে চলার পথ হোক—অহংকে পেছনে ফেলে, আমিত্ব ত্যাগ করে এগোতে হবে।
২. সংকোচ পুষে রাখবেন না
খেলার মাঠে বা কর্মক্ষেত্রে একটা খারাপ দিন আমাদের মনকে বিষণ্ন করতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিষণ্নতাকে মনে ধরে রেখে দিনের পর দিন সংকোচ পুষে রাখা মোটেও স্বাভাবিক নয়। গতকালের ব্যর্থতায় আমি আজ বসবাস করব না—অনেক বছর আগে আমি এ প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ঠিক করেছিলাম, মাঠের ব্যর্থতা মনের মধ্যে ধরে রাখব না। সেই অভ্যাস আমার ভেতর কোনো বিষণ্নতার জন্ম হতে দেয়নি, কোনো সংকোচকে বাসা বাঁধতে দেয়নি। মনে রাখবেন, সংকোচে পুষে রাখলে জীবনে স্থির হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
৩. নিজের কথা শুনুন
জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি পরিস্থিতিতে মানুষ আপনাকে নানা কিছু বোঝাতে আসবে, শেখাতে আসবে। কীভাবে খেললে ভালো হবে, কোন ক্যারিয়ারে আপনি ভালো করবেন, কী করা উচিত, কী উচিত না—এসব উপদেশ, পদে পদে আপনি পেতেই থাকবেন। আমি এখনো পাই! অনেকে আপনার ভালোর জন্যই হয়তো এসব বলবে। তাই সবারটাই শুনতে হবে। কিন্তু দিন শেষে আপনি সেই কথাই শুনুন, যেটা আপনার ভেতর থেকে আপনাকে সায় দেয়।
৪. শক্তিশালী ‘পার্টনারশিপ’ গড়ুন
আপনার জীবনের জন্য কোন পার্টনারশিপটা জুতসই হচ্ছে, সেটা বোঝা খুব জরুরি। ভালো পার্টনারশিপ শুধু ক্রিকেটে নয়; ব্যবসায়, বন্ধুত্বে, প্রেমে, সম্পর্কে, সর্বোপরি সফল জীবনের জন্য খুবই দরকার। লোকে ভাবে, পার্টনারশিপ শুধু ভালো ব্যাটিং রেকর্ড তৈরির জন্যই জরুরি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, খেলায় জেতার জন্য বোলিং পার্টনারশিপও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুজন মানুষ যখন একই একাগ্রতা নিয়ে একসঙ্গে একই লক্ষ্যের দিকে পৌঁছানোর জন্য এগিয়ে যায়, সেটা দেখতেও ভীষণ উপভোগ্য। তাই চলার পথে ভালো পার্টনারশিপের খোঁজ করে যেতে হবে।
৫. সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না
শারীরিক আঘাতের ভয় অনেক পেশাতেই থাকে না। আমার পেশায় ইনজুরি অবশ্যম্ভাবী। তবে পেশা–নির্বিশেষে আঘাতটা শারীরিক হোক কিংবা মানসিক—এটা মনে রাখতে হবে, আপনি একা নন। ভালো সময়ে যেই পরিবার, স্বজন আর কাছের বন্ধুরা আপনার উদ্যাপনের সঙ্গী হন, খারাপ সময়ে তাঁদের সাহায্য চাইতে সংকোচ করবেন না। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, পরিবার আর কাছের বন্ধুরা আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করতে পারে। আপনি শুধু জড়তা ভেঙে নিজেকে প্রকাশ করুন।
৬. শরীর ও মনে ভারসাম্য রাখুন
খেলায় সফল হতে হলে শরীর আর মন—দুইয়ের যত্নই সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়।
‘নিজেকে শান্ত রাখো’—বলতে খুব সহজ লাগলেও আদতে তা এত সহজ নয়। বাহ্যিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এক জিনিস আর এ চাপ সহ্য করে ভেতর থেকে নিজেকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখা পুরো অন্য এক সংগ্রাম। শারীরিক ও মানসিক—দুই স্বাস্থ্যের মধ্যে ভরসা রাখা কতটা চ্যালেঞ্জের, তা আমি আমার জীবনের দুটো সময়ে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্রথমটা, যখন আমি টেনিস এলবোর ইনজুরিতে পড়েছিলাম। আমি আর কখনো ব্যাট হাতে ভারতের হয়ে খেলতে পারব কি না, এ দুশ্চিন্তা ওই সময় আমাকে প্রতিমুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়াত। দ্বিতীয় ঘটনা হলো, ২০০৭ সালে ওডিআই বিশ্বকাপের প্রথম পর্বেই বাদ পড়ে যাওয়া। ওটা ছিল আমার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে সময়।
এ দুই পরিস্থিতিতেই ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তা আমাকে বাজেভাবে ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু দুই পরিস্থিতিতে আমি এ বিশ্বাসটুকু রেখেছিলাম যে একাগ্রতা, নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ আর কাছের মানুষদের সাহায্য, আস্থা ও যত্নে আমি আবার ফিরে আসতে পারব। একটু সময় লাগলেও আমার ওই বিশ্বাস আমাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিল।
আমরা প্রত্যেকে একটু সাহায্য আর সময়–সময় নিজের কথাগুলো বলার মতো একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয় খুঁজি। লকডাউন থেকে আমরা খুব ভালো উপলব্ধি করেছি যে শরীরের পাশাপাশি মনেরও কতটা পরিচর্যা জরুরি। তাই আমি বলব, শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনের যত্ন নেওয়া শুরু করুন। নিজের পাশাপাশি কাছের মানুষদের দিকে খেয়াল রাখতে শুরু করুন।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২৮, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,