ইউক্রেনে হামলা চালানোয় পশ্চিমা দেশগুলো মোটামুটি জোটবদ্ধ হয়ে রাশিয়ার ওপর একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। রাশিয়ার অর্থনীতি পঙ্গু করতেই এ নিষেধাজ্ঞা। তবে এতে যে শুধু রাশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। রাশিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইউরোপের অর্থনীতিও নিষেধাজ্ঞার কবলে ভুগবে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়বে।
রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এর একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করে রাশিয়ার আর্কটিক সাগরে। ইতালির বিলাসবহুল পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং জার্মানির গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা রয়েছে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের এক হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা ইউরোপের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অনিবার্যভাবে পড়তে যাচ্ছে এবং ইউক্রেনে যে ব্যবসা তাদের ছিল, যুদ্ধের কারণে সেখানেও সরবরাহ ব্যবস্থা ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউরোপের অন্যতম বাণিজ্যিক সহযোগী রাশিয়া। ২০২০ সালে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৩৭ শতাংশ হয়েছে ইউরোপের সঙ্গে। এর মধ্যে জ্বালানিই বেশি। রাশিয়া তার ৭০ শতাংশ গ্যাস রপ্তানি করে ইউরোপে। একই সঙ্গে রাশিয়া অর্ধেক তেল রপ্তানি করে এ অঞ্চলের দেশগুলোয়। এর বিপরীতে ইউরোপ বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করে, তার মাত্র ৫ শতাংশ যায় রাশিয়ায়। নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনে হামলার কারণে ইউরোপে ইতিমধ্যে গ্যাসসহ বিভিন্ন জ্বালানির দাম অনেক বেড়েছে।
ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করছে, বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করছে। দেশটিতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা রয়েছে, রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বিনিয়োগ রয়েছে। রাশিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি, আকাশযান ও বিলাসবহুল পণ্য তৈরিতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে।
ইউরোপের অন্যতম দেশ জার্মানির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ১০০ বছরের। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে রাশিয়ায় ব্যবসা করছে জার্মানির ডয়চে ব্যাংক ও সিমেন্স। এই ব্যবসা সব সময়ই অব্যাহত ছিল। এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সচল ছিল।
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের কাজ গত জানুয়ারিতেও চলেছে। ওই সময় সংঘাত এড়াতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলছিলেন। কিন্তু সেই সময় বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইতালির শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের প্রধান। দেশটিতে বিনিয়োগের বিষয়ে কথা বলেছেন পুতিন। এমন একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে আগামীকাল মঙ্গলবার। এই বৈঠকে জার্মানির প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নেওয়ার কথা।
ইউরোপের ব্যবসায়ীরা যে এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে ইতালি। দেশটির ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিলাসবহুল পণ্যসংক্রান্ত বাণিজ্যগুলো এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখা হোক। এ ছাড়া রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তার আওতা কমিয়ে আনা হোক।
নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফ্রান্সও। দেশটির প্রায় ৭০০টি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ কর্মী কাজ করে থাকেন। রাশিয়ায় বড় আকারের বাণিজ্য রয়েছে অস্ট্রিয়ারও।
এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জার্মানভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এনার্জির প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ব্রুক বলেন, ইউক্রেনে যে হামলা চালানো হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে ইউরোপ নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।
গত শুক্রবার ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লি মেয়ার বিবৃতিতে বলেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ধসিয়ে দেওয়ার পাশপাশি ইউরোপের অর্থনীতির ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে, সেই লক্ষ্যে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভারতও
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও। আউটলুক ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, সুইফটে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র আমদানির প্রক্রিয়া পিছিয়ে যেতে পারে। এ দুই দেশের মধ্যে ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে প্রতিবছর। ২০২০-২১ সালে দুই দেশের মধ্যে ৮১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল, পেট্রোলিয়ামজাতীয় অন্যান্য পদার্থ, কয়লা, সার, সোনা, মূল্যবান পাথর ও ধাতব পদার্থ আমদানি করে ভারত। শুধু রাশিয়া থেকেই ৬০–৭০ শতাংশ অস্ত্র কেনে দেশটি। এসব ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী 28, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,