ইউক্রেনে পুরোদমে চলছে রাশিয়ার হামলা। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রুশ সেনারা কিয়েভের পার্লামেন্ট ভবন থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরের শহর ওবোলনস্কিতে ঢুকে পড়েছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, হামলায় ১৩৭ সেনা ও বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। অথচ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরাবর বলে আসছিলেন, ইউক্রেনে হামলার কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই। কিন্তু এ কথায় মোটেও আস্থা রাখেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। রাশিয়ার অভিযান যে আসন্ন, সে বিষয়ে তিনি আগেই সতর্ক করেছেন।
বাইডেন শুধু সতর্ক করেই থেমে থাকেননি, যুক্তরাষ্ট্র যে এ নিয়ে কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় না, তা-ও স্পষ্ট করেছেন। সে রকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ইউক্রেন থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতেও যে কোনো সেনা পাঠানো হবে না, তা বলেছেন তিনি। উল্টো ইউক্রেনে থাকা মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ও পর্যবেক্ষকদের ফিরিয়ে এনেছেন। কেন মার্কিন সেনাদের যুদ্ধ করতে বাইডেন পাঠাবেন না, তা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে বিবিসি।
জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ নেই
প্রথমত, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিবেশী বা সীমান্তবর্তী দেশ নয়। আর ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও নেই। নেই ইউক্রেনের তেলের এমন কোনো মজুত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ আছে। এ ছাড়া ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদারও নয়।
তা সত্ত্বেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা অন্য দেশের পক্ষ হয়ে এমন অনেক যুদ্ধে জড়িয়েছেন, যেখানে অনেক রক্ত ও সম্পদ হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর শুরু হওয়া যুদ্ধে ১৯৯৫ সালে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একই কাজ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাঁর যুক্তি ছিল, তিনি মানবিক দিক বিবেচনা করে ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে এটি করেছেন।
১৯৯০ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নিল, তখন সেখানে কুয়েতের হয়ে যুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তখন ‘নীতিবহির্ভূত মানুষের আইনের’ বিরুদ্ধে আইনের শাসনের কথা বলে ওই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও শান্তি ও নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক নীতিকে রাশিয়া হুমকিতে ফেলছে দাবি করে একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন। তবে রাশিয়ার এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা সামরিক অভিযানের পরিবর্তে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটির অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
সামরিক হস্তক্ষেপের নীতিতে ‘বিশ্বাসী নন’ বাইডেন
এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের না জড়ানোর আরেক কারণ, প্রেসিডেন্ট বাইডেন সামরিক হস্তক্ষেপের নীতিতে ‘বিশ্বাসী নন’। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে এ বিশ্বাস এক দিনে তৈরি হয়নি। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তাঁর এ উপলব্ধি তৈরি হয়েছে। ১৯৯০–এর দশকে বলকান অঞ্চলে যে জাতিগত যুদ্ধ চলছিল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ তিনি সমর্থন করেছিলেন। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধেও তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি নিয়ে এসেছিল। এর পর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে বেশ সাবধান হয়ে ওঠেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বাইডেন এর বিরোধিতা করেছিলেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধে জেতার জন্য সেখানে বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনা পাঠানোর নীতির বিরুদ্ধেও ছিলেন তিনি। গত বছর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেখানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার পরও তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন।
বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২০ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন। মনে করা হয়, বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি তাঁর হাতেই তৈরি। ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বলতে সামরিক হস্তক্ষেপের চেয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা, বিশ্বব্যাপী মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করা ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে বেশি গুরুত্ব দেন।
মার্কিন নাগরিকেরা আর যুদ্ধে যেতে চাইছেন না
সাম্প্রতিক এক জরিপে (এপি-এনওআরসি পরিচালিত) বলা হচ্ছে, ৭২ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেওয়া উচিত নয় বা নিলেও সেটা খুব গৌণ হওয়া উচিত।
মার্কিন জনগণ এখন নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তিত। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ বেশি। আর মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এখন এটাই বেশি মাথায় রাখতে হচ্ছে।
তবে ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের দুই দিকের আইনপ্রণেতারাই এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোরতম নিষেধাজ্ঞার দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কট্টরপন্থী বলে যাঁরা পরিচিত, যেমন রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ, তাঁরাও চান না, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাক বা ‘পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক’।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আরেক কট্টর সমর্থক রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও একই অবস্থানে। তিনি বলেছেন, বিশ্বের দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ কারও জন্যই ভালো হবে না।
দুই পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধের বিপদ
এই সংকটে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরমাণু অস্ত্রের মজুত। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ কথা এরই মধ্যে প্রকাশ্যে বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ আর মার্কিন সেনারা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করুন, সেটা তিনি চান না।
চলতি মাসের শুরুতে এনবিসি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেছেন, ‘এখানে তো আমরা কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মোকাবিলা করছি না। আমরা এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর একটিকে নিয়ে কথা বলছি। এটি খুবই জটিল এক পরিস্থিতি; যা যেকোনো সময় বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে।’
চুক্তির দায় নেই
ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো চুক্তিও নেই যে তাদের ঝুঁকি নিতে হবে। ন্যাটোর সামরিক চুক্তির আর্টিকেল ৫-এ বলা আছে, যেকোনো সদস্যদেশের ওপর আক্রমণ সব দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে ও চুক্তির বলে প্রতিটি দেশ আক্রান্ত দেশকে রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তাই তাদের বেলায় সে রকম কোনো দায় নেই।
তবে এখানে বিড়ম্বনা হলো, ইউক্রেনকে ঘিরে এই সংঘাতের মূলে রয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের একটা দাবি—ইউক্রেন যেন ন্যাটো সামরিক জোটে যোগ দিতে না পারে, সেই নিশ্চয়তা। ন্যাটো আবার সেই নিশ্চয়তা দিতে চাইছে না।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ওয়াল্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর এই সমঝোতা প্রত্যাখ্যানের বাস্তবে কোনো মানে হয় না। কারণ, তারা তো সামরিক শক্তি নিয়ে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেও না।
যুক্তরাষ্ট্র কি অবস্থান বদলাতে পারে
প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য ইউরোপে মার্কিন সেনাদল পাঠাচ্ছেন ও ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন দেশে মোতায়েন করছেন; বিশেষ করে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে। বাইডেন প্রশাসন বলছে, রাশিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে ন্যাটো বাহিনীকে সরাতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের আরও কী বড় পরিকল্পনা রয়েছে, তা নিয়ে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট উদ্বেগ দূর করতেই এ ব্যবস্থা নিয়েছেন বাইডেন।
চলতি সপ্তাহে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান অবশ্যই সেই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার কারণে এই যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাও আছে। আর যদি সেটা হয়, তাহলে ন্যাটোর দেশগুলোকে রক্ষায় আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী মার্কিন বাহিনীকে যুদ্ধে জড়াতেই হবে।
বাইডেন বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশে হামলা চালান, তখন আমাদের সেখানে জড়াতেই হবে।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,