লেখা:অনিন্দ্য সাইমুম।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর পূর্বমুখী নীতি নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আপত্তি ছিল দীর্ঘদিনের। ঘরের উঠানে পশ্চিমা সেনা ও অস্ত্রের উপস্থিতি দেখতে নারাজ তিনি। এ নিয়ে উত্তেজনা আগে থেকেই ছিল। ইউক্রেনের সঙ্গে চলছিল বিরোধ। ২০১৪ সালেই সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেন পুতিন। এরপর থেকে সেই বিরোধ ক্ষণে ক্ষণে রং–রূপ বদলেছে। কিন্তু মিটে যায়নি। তাই ইউরোপে একটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী—এমনটা মনে করছিলেন অনেকেই।
পশ্চিমারাও আঁচ করছিলেন, পুতিনের রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হতে পারে ইউক্রেন। এ রকম পরিস্থিতিতে গত বছরের প্রথম দিকেই ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটান রুশ প্রেসিডেন্ট। তবে কি আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ইউরোপ—এই প্রশ্ন নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা যখন চরমে, তখন পুতিনকে বোঝাতে মস্কোয় ছুটে যান একের পর এক ইউরোপীয় নেতারা।
::যদি যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে আমরাও চালাব।
ভ্লাদিমির পুতিন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।::
সময়টা গত বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। মস্কো সফরে যান জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। উদ্দেশ্য, পুতিনের মন বোঝা, তাঁকে বোঝানো। সম্ভাব্য যুদ্ধ থেকে ইউরোপকে বাঁচানো। মস্কোয় টানা চার ঘণ্টা বৈঠকে করেন দুই নেতা। এই সময় জার্মান চ্যান্সেলরকে পুতিন বলেছিলেন, তিনি ইউরোপে যুদ্ধে জড়াতে চান না।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ফলাও করে পুতিনের ওই বক্তব্য প্রচার করে। পরে রুশ সেনাবাহিনী জানায়, ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধে না জড়ানোর বিষয়ে পুতিনের এই বক্তব্য জার্মান চ্যান্সেলর শলৎজ বিশ্বাস করেছিলেন কি না, সেটা জানা যায়নি। কিন্তু পুতিন যে সেকথা রাখেননি, তা দিবালোকের মতো সত্য। কেননা এর দিন দশেক পরে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে আক্রমণ শুরু করতে রুশ সেনাদের নির্দেশ দেন পুতিন।
যদিও পুতিনের ভাষায় এটা যুদ্ধ নয়, বিশেষ সামরিক অভিযান। তবে বাস্তবের যুদ্ধ–যুদ্ধ ভাব এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত যুদ্ধে গড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেদের মহাদেশে আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধ দেখেন ইউরোপবাসী।
২৪ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর কথা জানিয়ে এ সময় তিনি বলেন, ‘যুদ্ধে জড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না’।
হামলা নিয়ে পুতিনের ঘোষণা এক, ঘটেছে উল্টোটা
যুদ্ধ শুরুর পর দিন যত গড়িয়েছে, পাল্টাপাল্টি হামলা ততই জোরদার হয়েছে। তবে দুই পক্ষের কেউই কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি যুদ্ধে। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় ‘কনফারেন্স অন ইন্টারঅ্যাকশন অ্যান্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস ইন এশিয়া’ শীর্ষক এক সম্মেলনে যোগ দেন পুতিন।
সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ইউক্রেনে যে অভিযান চালানো হয়েছে, তা সঠিক ও সময়মতো চালানো হয়েছে। এটা নিয়ে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।’
আস্তানায় বসে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইঙ্গিত দেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে আর বড় ধরনের হামলা চালানোর প্রয়োজন দেখছি না। এখন থেকে ইউক্রেনে আর বড় কোনো হামলা চালাবে না রাশিয়া। আমাদের এখন অন্যান্য কাজ আছে।’ এমন বক্তব্যের পর বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছিলেন, পুতিন হয়তো যুদ্ধ থেকে সরে আসতে চাইছেন কিংবা যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে চাইছেন।
পুতিন বলেছিলেন এক কথা, করেছেন ঠিক উল্টোটা। ইউক্রেনে বড় হামলা বন্ধ হয়নি, জোরদার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজধানী কিয়েভসহ পুরো ইউক্রেন কেঁপে উঠেছে একের পর এক রুশ ক্ষেণাস্ত্রের আঘাতে। এমনকি দুই পক্ষের লড়াই হয়েছে ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশেও।
গত জানুয়ারির শুরুর দিকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের বড়দিন উৎসব উদ্যাপনের সময় একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল মস্কো। ৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার পরপরই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় হামলা চালায় রুশবাহিনী। এর আগে গত বছরের শেষ দিকে ইউক্রেনজুড়ে এক দিনে ১২০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে রাশিয়া।
এখন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে রাশিয়ার বাহিনী নতুন করে ইউক্রেনে বড় হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে—এমন অভিযোগ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভের। সম্প্রতি ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম বিএফএমকে ওলেকসি রেজনিকভ বলেন, বড় ধরনের হামলা চালাতে রাশিয়া প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করেছে।
ইউক্রেনের চার অঞ্চল দখল
চলতি মাসের প্রথম দিনে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন এক বিবৃতিতে জানায়, ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখলের বাসনায় পরিবর্তন আসেনি। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মস্কোয় এক আয়োজনে ইউক্রেনের চার অঞ্চল খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রুশ ফেডারেশনের অংশ ঘোষণা করেন পুতিন। এজন্য ওই চার অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করেছিল রাশিয়া। এ বিষয়ে সেদিন পুতিন বলেছিলেন, ‘এটা লাখ লাখ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল।’
এ ক্ষেত্রেও পুতিন তাঁর কথা রাখেননি। গত বছরের মার্চের শুরুতে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউক্রেনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করার কোনো লক্ষ্য রাশিয়ার নেই। ওই সময় স্কাই নিউজ অ্যারাবিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ দেখতে চান, নাৎসি মতাদর্শমুক্ত ইউক্রেন দেখতে চান। তিনি চান, ইউক্রেন যে নিরপেক্ষ তা তাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করবে।’
ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করার কথা উল্লেখ না করলেও মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভ্লাদিমির পুতিন দেশটির চারটি অঞ্চল গণভোটের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।
সমঝোতা আলোচনা নিয়ে পুতিনের অবস্থান
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন রোশিয়া–১ পুতিনের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে। তাতে যুদ্ধ বন্ধ ও ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘গ্রহণযোগ্য সমাধানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার জন্য আমরা প্রস্তুত। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই করছি, আমাদের নাগরিকদের ও জনগণের স্বার্থের সুরক্ষায় লড়ছি। জনগণকে রক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’
তবে বাস্তবে পুতিনের আলোচনায় বসার ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি। শান্তিপ্রক্রিয়াও আলোর মুখ দেখেনি; বরং সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মস্কোয় বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে পুতিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বা স্ট্র্যাটেজিক অফেনসিভ আর্মস ট্রিটি (নিউ স্টার্ট নামে পরিচিত) স্থগিতের ঘোষণা দেন। পুতিন বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তাহলে আমরাও চালাব।’
পারমাণবিক অস্ত্র (নতুন স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার ঘোষণা দেওয়া এবং নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর হুমকি দিয়ে পুতিন কার্যত ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ প্রলম্বিত করার আভাস দিয়েছেন।
****তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, আল–জাজিরা, ওয়াশিংটন পোস্ট ও রয়টার্স।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,