লেখক:সের্গেই আলেকসাশেঙ্কো।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর আট মাস পেরিয়েছে। ত্বরিত একটি সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে যে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু হয়েছিল, সেটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার সামরিক ও সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
যদিও এই যুদ্ধ ইউক্রেন ভূখণ্ডে সংঘটিত হচ্ছে, তাতে করে সেখানকার অসংখ্য মানুষের জীবন ও সম্পদহানি হচ্ছে। রাশিয়াও এই যুদ্ধে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, যা দেশটির অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদেশগুলো মস্কোর সরকারি কর্মকর্তা, আমদানি-রপ্তানি, ভারী শিল্প এবং তেল-গ্যাস খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেছিলেন, নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর এত বড় প্রভাব ফেলবে যে ক্রেমলিন তাদের আগ্রাসনের যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হবে। যাহোক, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বাজেট বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ ধারণা আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিষেধাজ্ঞা স্বল্প মেয়াদে মস্কোর ওপর তত বড় অর্থনৈতিক চাপ ফেলতে পারেনি, যাতে করে তারা নীতি বদলাতে বাধ্য হয়।
নিষেধাজ্ঞা এবং উপচে পড়া মুনাফা
পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে রাশিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু যতটা আশা তারা করেছিল, সেটা হয়নি। রাশিয়ার সরকার বলছে, ২০২২ সালে জিডিপি কমবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ আর দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, জিডিপি কমবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। মার্চ মাসে বিশেষজ্ঞরা ধারণা দিয়েছিলেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে এ বছর রাশিয়ার জিডিপি ৬ থেকে ৭ শতাংশ কমবে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপর রাশিয়ায় ভোগ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু মে মাসে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের ব্যাপক দরপতন হয়। ১ ডলারের বিনিময় হার ৭৫ রুবল থেকে বেড়ে ১৩৫ রুবলে গিয়ে পৌঁছায়। এতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রুবলের এই দরপতন ঠেকাতে রুশ কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এতে ডলারের বিপরীতে রুবলের মান বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১ ডলার সমান ৬০ রুবলে গিয়ে তা স্থিতিশীল রয়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যায়। ফলে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে। এর ফলে, এ বছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানি থেকে রাজস্ব আয় কমেছে ২০ শতাংশ। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সংঘাত রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপরও প্রভাব ফেলেছে। ২০২১ সালে রাশিয়ার জাতীয় রপ্তানির ৫০ শতাংশই ছিল জ্বালানি। কেন্দ্রীয় বাজেটে ৪৫ শতাংশ রাজস্ব আসে এ খাত থেকেই। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর বেশ আগে ২০২১ সালে গ্যাজপ্রম ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল, তাতে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম চড়েছিল।
এপ্রিল মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন, যেখানে বলা হয়, ইউরোপের কোনো কোম্পানি যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনতে চায়, তাহলে রুবলেই তাদের দাম শোধ করতে হবে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এতে সম্মত না হওয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় গ্যাজপ্রম। এপ্রিল ও মে মাসে ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে নর্ড স্টিম পাইপলাইনে নাশকতা জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
এসব কারণে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপে (তুরস্কসহ) গ্যাজপ্রমের গ্যাস রপ্তানি ৪৩ শতাংশ কমে যায়। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় এই গ্যাস রপ্তানিকারক কোম্পানির মোট রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশ।
রপ্তানি কমলেও রাজস্ব আয় কিন্তু কমেনি। জ্বালানি গ্যাসের দাম রকেট গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাজপ্রম বিপুল মুনাফা পেয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করেছে। আগস্ট মাসে মুনাফার এ প্রবণতা সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠে, ওই মাসে গ্যাসের দাম ৪৬০ শতাংশ বেড়ে যায়।
গ্যাজপ্রমের মুনাফা এতই বেড়ে গেছে যে সরকার কোম্পানিটির আয়ের ওপর নতুন করে কর আরোপ করেছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাসে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব যোগ হয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার।
জ্বালানি তেল খাতেও বাস্তবতা একই। রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা নিলে রাশিয়ার কোম্পানিগুলো নতুন ক্রেতার সন্ধানে নামে। ২৫ শতাংশ ছাড়কৃত মূল্যে তেল বিক্রির সুযোগ দেয় তারা।
এ বছরের বসন্ত ও গ্রীষ্মে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ১২০ ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। এখন সেটা অনেকটা কমে এসেছে। রাশিয়া ২০২১ সালে যে দামে তেল বিক্রি করেছিল, ছাড়কৃত দামে বিক্রি করার পর তেলের দাম এখন তার থেকেও বেশি।
সর্বোপরি, ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে ২০২১ সালের তুলনায় হাইড্রোকার্বন বা জ্বালানি উৎপাদন ও রপ্তানিতে ৩৪ শতাংশ বেশি রাজস্ব এসেছে।
যুদ্ধের ব্যয়
জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে গেলেও যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় এ বছর অনেক বেড়ে গেছে। সেপ্টেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, এ বছর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যয় ৩১ শতাংশ বাড়বে। আগের বছর যেখানে এ ব্যয় ছিল ৫৭ বিলিয়ন ডলার, সেখানে এ বছর তা বেড়ে হবে ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অস্ত্র কেনা ও মেরামতের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১০-১১ বিলিয়ন ডলারের হিসাবও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় বাজেটে এ বছর ‘সাধারণ জাতীয় বিষয়াদি’ নামে আরেকটি খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে এখানে। এ খাতে এবার ব্যয় হচ্ছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত বিভাগগুলোর ব্যয় এ খাত থেকে মেটানো হয়। এ খাতের অতিরিক্ত বরাদ্দ যুদ্ধে সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হবে বলেই ধারণা করা যায়।
২০২১ সালের তুলনায় এ বছর নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোয় ব্যয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ। অতিরিক্ত এই বরাদ্দের একটা বড় অংশ গেছে রাশিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের জন্য। এর সদস্যরা ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলদারি টিকিয়ে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
ক্রেমলিন সেনাবাহিনীর জন্য ৩ লাখ ১৮ হাজার সেনা নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য এ বছর অতিরিক্ত ৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
নতুন সেনা নিয়োগের আগেই ২০২৩ সালের বাজেট প্রণয়ন করা হয়। সে কারণে সামরিক খাতে ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রকৃত ব্যয় সরকার যেটা ঘোষণা করেছে, তার থেকে বেশি হবে। এ সবকিছু মিলিয়ে ২০২২ সালে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
গ্যাস ও তেল খাতে উপচে পড়া আয় যেমন বেড়েছে, আবার যুদ্ধসংক্রান্ত খাতে প্রচুর ব্যয় বেড়েছে। এর ফলে এ বছর রাশিয়ার জিডিপির ঘাটতি দাঁড়াবে দশমিক ৯ শতাংশ অথবা ১৫ বিলিয়ন ডলার।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ ডিসেম্বর থেকে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর রাশিয়ার জন্য বৈদেশিক ঋণের বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। দেশীয় কোনো উৎস থেকে বড় আকারের ঋণ নেওয়ার বাস্তবতা নেই। ফলে বাজেটের ঘাটতি সঞ্চিত সম্পদ থেকে মেটানো হবে বলে ধারণা করা হয়েছে। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন আগেই এর ঘোষণা দিয়েছেন।
অক্টোবর মাসের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ ১৭১ বিলিয়ন ডলার। এ সম্পদ থেকে ২০২২ সালের ঘাটতি পূরণ কোনো ঘটনা নয়। রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রকৃত চ্যালেঞ্জটা অপেক্ষা করছে ২০২৩ সালের জন্য। বাজেটে সামরিক ব্যয় জিডিপির সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে থাকছে, যার মধ্যে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণের অর্থও রয়েছে। ফলে সামরিক খাতে প্রকৃত ব্যয় খুব বেশি বাড়ছে না সামনের বছর।
কিন্তু রাজস্ব আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সামনের বছর সম্ভব না–ও হতে পারে। হাইড্রোকার্বন ও জ্বালানি খাতে উপচে পড়া মুনাফা থেকে ক্রেমলিন সরকার ভীষণ আশাবাদী যে ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এমনকি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্কলন থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে সরকারের এই আশাবাদী প্রাক্কলনের সঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ একমত নন।
হাইড্রোকার্বন বিশেষ করে জ্বালানি তেল থেকে আগামী বছর রাজস্ব কতটা আসবে, সেটা এখনো অজানা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ ডিসেম্বর থেকে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিশোধিত তেল কেনাও বন্ধ করে দেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার তেলের উপর প্রাইসক্যাপ বসিয়েছে। রাশিয়ার তেল ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের বেশি দামে কেউ কিনতে পারবে না।
এর ফলে যুদ্ধ শুরুর আগের তুলনায় রাশিয়া আগামী বছর তেলের রপ্তানি বাড়াতে পারবে, এমনটা ভাবা যৌক্তিক হবে না। ২০২১ সালে রাশিয়ার তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় দাম ছিল ৬৯ ডলার। ২০২১ সালের তুলনায় এখন রুবল-ডলার বিনিময় হার গড়ে ১৫ শতাংশ বেশি। আগামী বছরেও ও প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
এর ফলে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হাইড্রোকার্বন উৎপাদন ও রপ্তানি থেকে রাজস্ব ১৫-২০ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার তেল ও গ্যাস কোম্পানি এবং ধাতু ও কয়লা উৎপাদকদের ওপর কর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে রাজস্ব আয় যতটা কমবে, তার ৭৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।
বড় অনিশ্চয়তার মধ্যেও রাশিয়া সরকার যে বাজেট দিয়েছে, সেটা পরিকল্পিত। আগামী বছর রাজস্ব আয় কমবেশি সরকারের পরিকল্পনার মধ্যেই থাকবে। পক্ষান্তরে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত রাশিয়ার বাজেটের ওপর তেমন প্রভাব ফেলছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরে আসার মতো অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে না ক্রেমলিন।
****সের্গেই আলেকসাশেঙ্কো, রাশিয়ার সাবেক উপ-অর্থমন্ত্রী
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
সূত্র:প্রথম আলো
তারিখ:ডিসেম্বর ০৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,