ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ইউক্রেন শুরু করতে পারবে কি না, তা আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ জানতে পারবে কিয়েভ। গতকাল শনিবার আকস্মিক সফরে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে গিয়ে এসব কথা জানান ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন।
ইউক্রেনের পাশাপাশি মলদোভা ও জর্জিয়াকে ইইউর সদস্যপদের প্রার্থী হিসেবে স্বাগত জানানো হবে কি না, সে বিষয়ে চলতি মাসের শেষ দিকে সিদ্ধান্ত নেবেন জোটের নেতারা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এই আগ্রাসন সাবেক তিন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেন, মলদোভা ও জর্জিয়াকে ইইউতে জরুরি আবেদন জমা দিতে প্ররোচিত করেছে।
ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে। একই কথা মলদোভার ক্ষেত্রেও বলা যায়। তবে জর্জিয়ার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কারণ, দিন কয়েক আগে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের এক প্রস্তাব জর্জিয়ার জন্য ধাক্কা হয়ে এসেছে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে ইইউতে যোগদান একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—বর্তমানে এই যুক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউক্রেন। বিশেষ করে, ইউক্রেনে রুশ হামলা কিয়েভের এই যুক্তিকে জোরদার করেছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্দেশে ইউক্রেনের পার্লামেন্টের স্পিকার রুসলান স্টেফানচুক বলেন, কিয়েভকে জোটের প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়া হলে তা ইউক্রেনীয় জনগণকে ক্ষমতায়িত করবে। তার বাইরে যেকোনো সংকেত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেই শুধু সুবিধা দেবে।
মলদোভার প্রেসিডেন্ট মাইয়া সান্ডু ইইউপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি গত মাসে ইইউর সদস্যদের বলেন, তাঁর দেশকে হয়তো এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
তবে মাইয়া সান্ডু ইইউর সদস্যদের এ কথাও মনে করিয়ে দেন যে তাঁর দেশের অনেক নাগরিক তাদের বাড়িতে বসেই ইউক্রেনীয় শহর ওডেসাতে রুশ বোমা পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
ইউক্রেন ও মলদোভার আবেদনের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটের মুখে রয়েছে। আর মলদোভা আছে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরবর্তী ঝুঁকিতে।
উভয় দেশকে ইইউর সদস্যপদ প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছে থিঙ্ক ট্যাংকটি। তারা বলছে, এই মর্যাদা দেশ দুটিকে ইইউতে প্রবেশের নিশ্চয়তা দেবে না। তবে তা এই লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
জর্জিয়ার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সুযোগ দেশটিকে এখনই দেওয়া হলে তা অপরিপক্ব হবে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের দিক দিয়ে ইউক্রেন ও মলদোভাকে ছাড়িয়ে গেছে জর্জিয়া। তবে গণতন্ত্রের বিষয়ে দেশটি পিছিয়ে আছে। দেশটির বর্তমান গণতন্ত্র পরিস্থিতি ইইউর মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না।
গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব নিয়েছে। এই প্রস্তাবে জর্জিয়াকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সর্বোচ্চ মান সমুন্নত রাখতে বলা হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশটির সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। প্রস্তাবে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো ও নিপীড়নের নিন্দা জানানো হয়েছে।
গত গ্রীষ্মে জর্জিয়ায় ৫০ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মী ডানপন্থীদের সহিংসতায় আহত হন। কিন্তু দেশটির সরকার কাউকে বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো দেশটির সরকারের সমালোচনাকারী স্বাধীন গণমাধ্যমের মালিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
জর্জিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিরোধী টিভি চ্যানেলের প্রধান নিকা গাভারামিয়াকে গত মাসে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই কারাদণ্ডকে রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের নির্লজ্জ উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
আইনজীবীর মাধ্যমে বিবিসিকে দেওয়া একটি চিঠিতে নিকা লেখেন, তিনি একজন রাজনৈতিক বন্দী। তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানির তহবিল অপব্যবহারের দায়ে নিকাকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়ার মাধ্যমে জর্জিয়ার ভবিষ্যতের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
দেশি-বিদেশি সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে জর্জিয়ার সরকার। তারা নিকাকে সাংবাদিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন বিরোধী নেতা হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবটিরও সমালোচনা করেছে জর্জিয়া।
জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি গারিবাসভিলি চলতি মাসের শুরুর দিকে বলেন, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত আশা করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশে ইরাকলি বলেন, ‘আসুন খোলামেলা কথা বলি। ২০০৮ সালে রাশিয়া যখন জর্জিয়ায় আক্রমণ করেছিল, তখন এই বিশ্বের কেউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।’
ইরাকলির মতে, কোনো দেশে আক্রমণ চালিয়েও যে দায়মুক্তি পাওয়া যায়, সেই ভাবনা রাশিয়ার মধ্যে আসে জর্জিয়ায় হামলার ঘটনায়। তারপর ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু করে।
জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, ইউক্রেন ও মলদোভার মতো তাঁর দেশও ইইউ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। জর্জিয়ার ব্যাপারে ইইউর জবাব অবশ্যই পর্যাপ্ত ও প্রাসঙ্গিক হতে হবে। হতে হবে আনুপাতিক।
জর্জিয়ার সরকারকে প্রতিশ্রুত সংস্কার, বিশেষ করে, একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উৎসাহিত করছে ইইউ। তবে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাশভিলিসহ অন্যান্য বিরোধী ব্যক্তিদের প্রতি জর্জিয়া সরকারের আচরণ ইইউর উদ্বিগ্ন বাড়িয়ে তুলছে।
জর্জিয়ায় রুশ আগ্রাসনের সময় ক্ষমতায় ছিলেন মিখাইল সাকাশভিল। নির্বাচনে বিরোধীদের সমর্থন জানাতে গত বছর তিনি দেশে ফিরলে তাঁকে আটক করা হয়। তিনি ও নিকা উভয়ই বলেন, তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। এ অবস্থায় ইইউর সদস্যপদ প্রার্থীর মর্যাদা পেতে জর্জিয়াকে অবশ্যই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে।
****বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ১২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,