ইউক্রেন সংকট নিয়ে কিছুদিন ধরে ভারতকে একধরনের কূটনৈতিক টানাটানির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই ইস্যুতে মস্কো ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন সংকট নিয়ে নয়াদিল্লি প্রথম যে বিবৃতিটি দিয়েছে, তাতে সরাসরি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিবৃতিতে নয়াদিল্লি বলেছে, সংকটের সমাধানে কূটনীতি ও সংলাপকে সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে কর্ণপাত করা হয়নি বলে তারা দুঃখিত।
বিবৃতি দিলেও ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে ভারত। ভারত কী কারণে রাশিয়ার সমালোচনা করছে না, তা এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে বিবিসি অনলাইন।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির আগেই রাশিয়া, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র ‘সঠিক কাজ’ করার জন্য নয়াদিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।
একটি সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া প্রকাশ্যে নয়াদিল্লির প্রতি আবেদন পর্যন্ত জানিয়েছিল।
কিন্তু ভারত নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের দেওয়া বিবৃতিটি ভালোভাবে পড়লে বোঝা যায়, নয়াদিল্লি পরোক্ষভাবে মস্কোকে আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করতে বলেছে।
ভারত জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের গুরুত্বের কথা বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে। একই সঙ্গে নয়াদিল্লি বলেছে, সংকট সমাধানের লক্ষ্যে একটি গঠনমূলক পন্থা খুঁজে পেতে সব সদস্যরাষ্ট্রকে এই নীতিগুলোকে সম্মান করতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে ভারতের বিরত থাকার সিদ্ধান্তটি, বিশেষ করে পশ্চিমে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নটি হলো, ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের আরও সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল কি না।
ভালো বিকল্প নেই
ভারতের সাবেক কূটনীতিক জে এন মিশ্রের মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের সামনে যেসব বিকল্প আসে, তা কোনোটিই ভালো নয়।
জে এন মিশ্র বলেন, কেউ একই সময় উভয় দিকে কাত হতে পারে না। ভারত তার বিবৃতিতে কোনো দেশের নাম নেয়নি। যার অর্থ দাঁড়ায়, নয়াদিল্লি মস্কোর বিরুদ্ধে যাবে না। এ অবস্থায় ভারতকে একটি সূক্ষ্ম পন্থা বেছে নিতে হয়।
ইউক্রেন ইস্যুতে কূটনৈতিক ভারসাম্যের একটি অবস্থান খুঁজে পেতে ভারতকে বেগ পেতে হয়েছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক।
রাশিয়া এখনো ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও এই সরবরাহের পরিমাণ ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ভারত অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি দেশটি অভ্যন্তরীণভাবে অস্ত্র উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
রাশিয়া এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মতো সামরিক সরঞ্জাম ভারতকে সরবরাহ করছে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সংগত কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির সত্ত্বেও রাশিয়ার কাছ থেকে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বিরত হয়নি ভারত।
বিজ্ঞাপন
প্রতিরক্ষা সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ
বেশ কিছু বিষয়ে দশকের পর দশক ধরে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে কূটনৈতিক সহযোগিতা, তার ইতিহাসকে হুট করে উপেক্ষা করা নয়াদিল্লির পক্ষে কঠিন।
ভারতকে কাশ্মীরের মতো দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে সাহায্য করতে মস্কো অতীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে তার ‘বিখ্যাত’ কৌশল অনুসরণ করছে। সংকট সমাধানের জন্য সংলাপের বার্তা প্রচার করছে ভারত।
থিঙ্কট্যাংক উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে ভারতের অবস্থান বিস্ময়কর নয়। নয়াদিল্লির এই অবস্থান তার অতীত কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ইউক্রেনে যা ঘটছে, তাতে নয়াদিল্লি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। কিন্তু তাই বলে নয়াদিল্লির অবস্থান বদল করারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক বলেন, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনে এই মুহূর্তে ভারত তার অবস্থান বদল করতে পারবে না। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নয়াদিল্লি কিছু কঠোর শব্দ উচ্চারণ করেছে। নয়াদিল্লি যে ইউক্রেন সংকটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না, তা বোঝাতেই তারা এমনটা করেছে।
ইউক্রেন থেকে ২০ হাজারের বেশি ভারতীয় নাগরিককে, যাঁদের বেশির ভাগই ছাত্র, সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও নয়াদিল্লির জন্য একটি কঠিন কাজ।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত একসময় রাশিয়া ও লিবিয়ায় কাজ করেছেন। ২০১১ সালে লিবিয়ায় সংঘাত শুরু হয় ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজের তদারকি করেন অনিল ত্রিগুনায়াত। তিনি বলেন, ইউক্রেন থেকে ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার অভিযান সফল করার জন্য এই সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, ভারত তার নাগরিকদের নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে ফেলে একটি পক্ষ নিতে পারে না। একই সঙ্গে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এখানে ভারতের জন্য সব কটি চ্যানেল খোলা রাখা জরুরি।
তা ছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বর্তমানে একটি ‘অনন্য’ অবস্থানে রয়েছে। কারণ, ভারত এমন একটি দেশ, যার সঙ্গে ওয়াশিংটন ও মস্কো উভয়েরই সুসম্পর্ক রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, উভয় পক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা রাখার ক্ষেত্রে ভারত ভালো করছে।
অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি। কিন্তু বিষয়টি এমনও নয় যে ভারত ইউক্রেনবাসীর ওপর নেমে আসা দুর্ভোগ-দুর্দশার ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ভারত একটি ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত আঞ্চলিক অখণ্ডতা সম্পর্কে জোরালো বক্তব্য রেখেছে। এর স্পষ্ট উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেনের দুর্দশার কথা তুলে ধরা।
কিন্তু ওয়াশিংটন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা যদি রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রাখে, তাহলে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এই মুহূর্তে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সব সময় যে এই দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রাখবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করতে যাচ্ছি। আমরা বিষয়টি পুরোপুরি সমাধান করিনি।’
বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে
রেটিং করুনঃ ,