ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করেছে বলে অনুমান করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে করে পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউক্রেনের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার একটি সামরিক আগ্রাসন অবশ্যম্ভাবী। খবর সিএনএনের।
যুদ্ধ এড়াতে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতাও চলছে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের জন্য আসন্ন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি এ আগ্রাসন শুরু হয়, তাহলে কোন দিক থেকে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে তিন দিক থেকেই ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে রাশিয়া। দক্ষিণে ক্রিমিয়া সীমান্ত, দুই দেশের সীমান্তে রাশিয়া অংশ ও উত্তরে বেলারুশ সীমান্ত থেকে আগ্রাসন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাশিয়া যে তিন দিক থেকে অভিযান চালাতে পারে, সেসব এলাকায় নজর রাখছে ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলো। এসব এলাকায় রাশিয়ার গতিবিধি দেখা যাচ্ছে।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল
সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে পূর্ব ইউক্রেনের দুই বিচ্ছিন্ন অঞ্চল দনিয়েস্ক ও লুহানস্ক। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও রাশিয়ার সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে এখানে সশস্ত্র লড়াই চলছে।
রাশিয়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন, এমন অনেকেরই ধারণা, যেসব এলাকায় নিজেদের বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেখানে আরও সেনা পাঠাতে পারে মস্কো।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে নিজেদের থাকা এলাকায় সেনা ও সমরাস্ত্র পাঠিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার ইয়েলনিয়া সামরিক ঘাঁটি
উপগ্রহ থেকে তোলা কিছু ছবি পেয়েছে সিএনএন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ইয়েলনিয়ায় থাকা রাশিয়ার ট্যাংক, কামান ও অন্য সমরাস্ত্রগুলোর বেশির ভাগই খালি করে ফেলা হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সামরিক এসব সরঞ্জাম যেখান থেকে যুদ্ধ হতে পারে, সেসব এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের শেষ দিকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ওই সেনাঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭০০টি ট্যাংক, পদাতিক সেনাদের লড়াইয়ের জন্য সাঁজোয়া যান ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, এসব সমরাস্ত্র ট্রেনে করে ও সড়কপথে আরও দক্ষিণে ইউক্রেনের কাছাকাছি ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিএনএন জানিয়েছে, এর আগে এসব সমরাস্ত্র, গোলাবারুদ ও সাঁজোয়া যান ইয়েলনিয়ার ওই ইউনিটে দেখা গেছে।
বেলারুশ
মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র বেলারুশেও রয়েছে রুশ সেনাদের ব্যাপক উপস্থিতি। দেশটি ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের আরেকটি পথ হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সীমান্তে ১০ দিনের যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে রাশিয়া ও বেলারুশ। এর পরিধি ও সময় নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে।
বেলারুশে মস্কোর বর্তমান সামরিক উপস্থিতি স্নায়ুযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ বলে ধারণা করা হচ্ছে। ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ ৩ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে এক হিসাব দেন। তিনি বলেন, অনুমান করা হচ্ছে, বেলারুশে এখন রাশিয়ার ৩০ হাজার পদাতিক সেনা রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে স্পেৎসনাজ নামের বিশেষ বাহিনী, সুখোই-৩৫ মডেলের যুদ্ধবিমান, দ্বৈত ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র ইস্কান্দার এবং এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছরের যেকোনো সময় বিবেচনায় বেলারুশের সশস্ত্র বাহিনীর এটি সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য দাবি করেছে, বিদেশি আগ্রাসন ঠেকাতেই অ্যালায়েড রিজলভ-২০২২ নামে যৌথ এ সামরিক মহড়া চালানো হচ্ছে।
তবে অনেকের শঙ্কা, উত্তর দিক থেকে যাতে সরাসরি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে হামলা চালানো যায়, এ জন্যই এমন সমর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। ইউরোপের একজন কূটনীতিক ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সিএনএনকে রাশিয়ার এ ব্যাপক সেনাসমাবেশকে অনেক বড় একটি চিন্তার কারণ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, এর মাধ্যমে যেকোনো মুহূর্তে খুব দ্রুততার সঙ্গে ইউক্রেনের রাজধানী শহরে হামলা করতে পারবে রাশিয়া।
সিএসআইএস সতর্ক করে বলেছে, বেলারুশে রাশিয়ার এমন সামরিক কর্মকাণ্ড উত্তর ইউক্রেনে মস্কো যে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, সেটা আড়াল করে দেবে।
এ ছাড়া মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সার টেকনোলজিসের প্রকাশিত উপগ্রহচিত্রে দেখা যায়, বেলারুশের বিভিন্ন এলাকায় সেনা মোতায়েন জোরদার করেছে রাশিয়া। সম্ভবত সামরিক মহড়ার জন্য এসব সেনা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনের সীমান্তের কাছ ঘেঁষে এসব সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া যেখানে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সামরিক মহড়া চলছে, সেখান থেকে এসব সেনাঘাঁটি কয়েক শ মাইল দূরে।
তবে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর জন্য রাশিয়া যদি বেলারুশকেই বেছে নেয়, তাহলে এ পথে অভিযান চালিয়ে যাওয়াটা রাশিয়ার জন্য বেশ কঠিনই হবে।
ক্রিমিয়া
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। স্বভাবতই ক্রিমিয়া সীমান্ত ব্যবহার করে ইউক্রেনে নতুন কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করাটা হবে রাশিয়ার জন্য তুলনামূলক সহজ। কিন্তু ক্রিমিয়া সীমান্ত ব্যবহার করে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করবে কি না, সেটা এখনো তেমন স্পষ্ট নয়।
মাক্সারের প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ক্রিমিয়ায় বিপুল পরিমাণ সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মাক্সারের পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে, ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারপুলের উত্তরে সেনাদের জন্য সাড়ে পাঁচ শতাধিক তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে এবং শত শত সমরযান নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে।
গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো সেখানে রাশিয়ার নতুন সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি চিহ্নিত করে মাক্সার। উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় যে ক্রিমিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় ছোট শহর স্লাভানের কাছে সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করেছে রাশিয়া।
একই দিনে নতুন করে যেসব সামরিক উপস্থিতির বিষয় চিহ্নিত করা হয়, এর মধ্যে দেখা যায়, ক্রিমিয়ার প্রধান বন্দর সিভাস্তোপোলে রাশিয়ার একাধিক রণতরি ভিড়েছে। বৃহস্পতিবারই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু ছবি পোস্ট করে। তাতে দেখা যায়, সিভাস্তোপল বন্দরে রাশিয়ার ছয়টি বড় জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে।
প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের নৌবাহিনী বলে, ‘রাশিয়া কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সামরিকীকরণ অব্যাহত রেখেছে। সেখানে অতিরিক্ত জাহাজ ভিড়িয়ে ইউক্রেন ও বিশ্বের ওপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের নৌবাহিনী ‘সমুদ্র থেকে দেশকে রক্ষায় যেকোনো পরিস্থিতি ও উসকানি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’
সিএসআইএসের বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্রিমিয়া থেকে এসব বড় যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সরাসরি ইউক্রেনের বন্দরনগরী ওডেসায় ঢুকে পড়তে পারে রাশিয়া। তবে তাঁরা এ–ও বলছেন, এতে বড় ধরনের সফলতার সম্ভাবনা থাকলেও বড় ধরনের ঝুঁকিও রয়েছে। জনবহুল ওডেসায় রাশিয়াকে ঠেকাবে প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ ছাড়া এ পথে অভিযান চালাতে হলে রাশিয়ার সেনাদের ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভাঙতে হবে এবং তারপর ইউক্রেনের সেনাদের মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,