লেখক: তাপসী বণিক
মুক্ত–স্বাধীন দেশে আমরা বুকভরে নিশ্বাস নিই। এ বায়ু আমাদের ধমনিকে রাখে সচল, হৃদয়কে রাখে সক্রিয়। স্বাধীনতার সুখ অতুলনীয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধি—সবকিছুই আমাদের উজ্জীবিত করে। তাই যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের স্বাধীনতা, তাঁদের প্রতি জানাই অসীম কৃতজ্ঞতা।
স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নির্বাচনী বিষয়গুলোর জন্য বইপত্র অপ্রতুল থাকায় ইংরেজি ভার্সনেই পড়ত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী, তবে যেসব শিক্ষার্থী বাংলায় পড়তে চাইত, তাদের সেই স্বাধীনতা ছিল। এমনকি বাংলা–ইংরেজির সংমিশ্রণে উত্তরপত্র লেখার প্রচলনও ছিল।
তারপর ধীরে ধীরে আমরা বাংলা ভাষায় সমস্ত বইপত্র পেতে শুরু করি এবং বাংলা ভার্সনেই বোর্ডনির্ধারিত পড়ালেখা প্রচলন ছিল। আমরা সেভাবেই পড়ে এসেছি।
সময়ের হাত ধরে শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন-বিবর্তন-উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের পরে আবার নতুন করে শুরু হয় ইংরেজি ভার্সনে পড়ালেখার প্রচলন, যা বাংলা ভার্সনের পাশাপাশি চলে আসছে। এ ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অনেকে ইংরেজি মাধ্যমে (ইংলিশ মিডিয়াম) কিছুটা পথ অতিক্রম করে পঞ্চম-সপ্তম শ্রেণিতে ইংরেজি ভার্সনে চলে আসে।
এর দুটি কারণ—প্রথমত, ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনায় ব্যয় বাংলা ভার্সনের চেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, অনেকেই দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিক্ষা নিতে চান ইংরেজিতে। তাতে বিষয়জ্ঞানের পাশাপাশি ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ে। এ কারণে পরবর্তী শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে অনেকটা সুবিধা পাওয়া যায়।
তবে যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, আমাদের উচিত তাদের প্রাপ্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। তবে এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভার্সনে পড়া শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ও কর্মজীবনে কিছুটা সুবিধা পেলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে পারছি না। অনেক সময় বোর্ডনির্ধারিত বইগুলো বাংলা ভার্সনের ক্ষেত্রে জানুয়ারি মাসে পাওয়া গেলেও ইংরেজি ভার্সনের ক্ষেত্রে তা সহজলভ্য হতে মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। আবার বোর্ডনির্ধারিত বইগুলো পাওয়া গেলেও মাধ্যমিক স্তরের টেস্ট পেপার তিন থেকে চার বছর আগেও সহজলভ্য ছিল না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি তার প্রস্তুতি যাচাই করার অন্যতম শিক্ষা উপকরণ হলো টেস্ট পেপার। অথচ তা আমরা দিতে পারিনি।
এবার আসি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। এর অবস্থা আরও করুণ। ২০১৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলোর সব কটি প্রকাশিত হয়নি। সেই সীমাবদ্ধতা ছিল নতুন সিলেবাসের কারণে। পরে অনেকের উদ্যোগে আজ আমরা সে আকাল পার করেছি বটে তবে প্রশ্ন ব্যাংক বা টেস্ট পেপার আসে প্রথম ২০১৯ সালে। একজন শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এবার যদি বোর্ডের প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গে আসি, তাহলে কষ্টের বোঝা আরও ভারী হবে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র সহজলভ্য নয়, অনেক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে বাংলা ভার্সনের প্রশ্নে (২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে)। বিষয়টি শুধু অনিয়ম নয়, বরং অমানবিক। তাই ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অতিসম্প্রতি কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রমে অনেকটা পরিবর্তন আনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে)। অথচ এদের কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ইংরেজি ভার্সনের জন্য দেওয়া হয়নি, এ কারণে আরেক ধাপে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।
আমরা জানি, আমাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের হয়রানি বন্ধে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রকাশক ও শিক্ষা বোর্ডের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। প্রকাশকদের শুধু লাভের আশা না করে সমাজের একটি বিশাল অংশের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ও প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা করি, পরবর্তী সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার সময় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আসবে এবং সমস্ত বোর্ড পরীক্ষায় তার সুপ্রভাব দেখতে পাব। মনে রাখতে হবে, ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন আর নগণ্য নয়, বরং বিবেচনাযোগ্য এবং এর ব্যাপ্তি ও কাল নাতিদীর্ঘ হলেও শৈশব নয়; এটি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দ্বারে পৌঁছেছে।
*লেখক: তাপসী বণিক, সহযোগী অধ্যাপক, কোডা, ধানমন্ডি, ঢাকা
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,