লেখক:সালেহীন আরশাদী।
এক দশকে হিমালয়ের নানা অঞ্চলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, নামী-অনামী কয়েকটা চূড়াতে আরোহণও করেছি। গত সপ্তাহেই ফিরে এসেছি মানসিরি হিমালয় থেকে। তিন সপ্তাহের অভিযানে অপূর্ব সুন্দর হিমালয়ের স্যুম উপত্যকা ও মানাসলুর লারকে লা গিরিবর্ত অতিক্রম করেছি। পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলুর কোলের ছোট্ট একটি চূড়াতেও আরোহণ করেছি। কিন্তু আজকে পর্বতারোহণ নিয়ে কিছু লিখতে বসে সেই সব সফল অভিযানগুলোর কথা মাথায় আসছে না। অভিযানে আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের ভুলগুলোই বারবার মনে পড়ছে। তাই মনে হলো কোনো অভিযানের গল্প না লিখে আমাদের পর্বতারোহণের দর্শন নিয়েই কিছু লেখার চেষ্টা করি।
আমরা পর্বতারোহণের একটি বিশেষ ধারা, ‘অ্যালপাইনিজম’ চর্চা করি। আমার জন্য ‘অ্যালপাইনিজম’ হলো একটি উপলব্ধি, একটি দর্শন, একটি লাইফস্টাইল।
‘অ্যালপাইনিজম’ মানে হচ্ছে কারও সাহায্য না নিয়ে নিজের সামর্থ্য দিয়ে পর্বতারোহণ করা। এখানে ভারী মালামালগুলো বহনের জন্য কোনো পোর্টার থাকবে না, পথ দেখানোর জন্য কোনো গাইড থাকবে না, রান্না করে দেওয়ার জন্য থাকবে না কোনো কুক। পর্বতে সব কাজ নিজেকেই করতে হবে। অল্প কথায় অ্যালপাইনিজমকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও এখানেই এর ব্যাপ্তি শেষ হয়ে যায় না। তাই অ্যালপাইনিজমের সংজ্ঞা দেওয়া তো দূরের কথা, একে ব্যাখ্যা করাই একটা মুশকিলের কাজ। এটি অতল এক গহ্বর, যেখানে ডুব দিয়ে আমি এখনো তলানি খুঁজে পাইনি। আমি প্রতিদিন বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেই বোধটুকু, যেটা আমাকে এই দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…
প্রথম দিকের একটি অভিযানের একটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম ভারত হিমালয়ের একটি পর্বত রেকি করতে। পর্বতটির নাম কারচা। ৬ হাজার ২৭০ মিটার উঁচু এই পর্বতে যাওয়ার সম্ভাব্য দুটি রুটের কোনটা বেশি বাস্তবসম্মত আর তুলনামূলক কম বিপজ্জনক, সেটা যাচাই করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আমাদের তিনজনের দলের একজন সদস্য অভিযান শুরু হওয়ার আগেই ছোট একটা দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। পরে আমরা দুজন মিলে অভিযানের শেষ ধাপটুকু সম্পন্ন করি।
সেদিন আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার ওপরে কালিনালা হিমবাহে ৩ নম্বর ক্যাম্প স্থাপন করেছি। হাঁটুসমান তুষারে ঢাকা হিমবাহের ওপর জীবনে প্রথমবারের মতো আমাদের ক্যাম্প। সেদিনের তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। চারপাশের সবকিছু জমে আছে।
অনেক কষ্টে নরম তুষার সমান করে দুজন মিলে তাঁবু টানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে ফেললাম। এবার আমাদের প্রথম কাজ খাওয়ার পানি বানানো। নরম তুষার গলিয়ে বানাতে হয় এই পানি।
সেদিন দুপুর থেকেই হিমালয়ের মনমেজাজ খারাপ। ভয়ানক বাতাস বইছিল। দুপুর থেকেই আকাশের গায়ে কালো কালো মেঘ জমতে দেখেছি। আগের দিনও এ রকম সময়ে তুষারপাত শুরু হয়েছিল। আজকেও যে হবে, সেটা অনায়াসে বলে দেওয়া যায়। তাই আমরা তাড়াতাড়ি তুষার গলিয়ে পানি বানানো ও রান্না করার কাজটা শেষ করে তাঁবুতে ঢুকে যেতে চাচ্ছিলাম।
পাথর দিয়ে একটা ঘেরাওয়ের মতো বানিয়ে নিলাম। একটি বড় পাথরের ওপর সদ্য কেনা প্রাইমাস স্টোভটা রেখে চারদিক অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে ঢেকে দিলাম যেন বাতাস না লাগে। এরপর ডিজেলভর্তি বোতলে পাম্প করা শুরু করলাম। একটা, দুইটা, তিনটা…দশটা, বিশটা দেওয়ার পরই হাঁপিয়ে গেলাম। আমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার ৪০০ মিটার ওপরে আছি। এই উচ্চতায় অক্সিজেনের পরিমাণ সমতল থেকে অনেক কম। তাই অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি।
এরপর শুরু হলো আসল পরীক্ষা। স্টোভের মধ্যে তেল অ্যাডজাস্ট করা। স্টোভে তেল যাচ্ছে কি না, দেখার জন্য আমাকে ঝুঁকে দেখতে হচ্ছিল। মাথায় আবার হাইপাওয়ারের হেডল্যাম্প। হেডল্যাম্পের আলো অ্যালুমিনিয়াম শিটে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি কিছুটা ঠিকঠাক হতেই দেশলাই কাঠি জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। মোটা গ্লাভস দিয়ে কোনোরকম কাঠি জ্বালানো গেলেও স্টোভের সেই সরু জায়গা দিয়ে কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালানো সম্ভব হলো না। এখন আমাকে হাত থেকে গ্লাভস খুলতে হবে। গ্লাভসটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হাত জমে যাওয়ার অনুভূতি কতটা বাজে হতে পারে, কাউকে সেটা বলে বোঝাতে পারব না । মনে হবে, চাপাতি দিয়ে কেউ হাত কেটে ফেলেছে।
এরপর শুধু যুদ্ধ করে যাওয়া। কাঠি জ্বালাই, বাতাসে নিভে যায়। কাঠি জ্বালাই, স্টোভের কাছে নিতে নিতেই নিভে যায়। আবার কাঠি জ্বালাই, স্টোভের কাছে নিয়েও যাই ঠিকঠাক কিন্তু হাতটা সলতের সঙ্গে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায়।
এদিকে আমার হাতের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে যাচ্ছে। ভালোভাবে হাত মুঠো করতে পারছি না। বারবার হাত ঘষে ঘষে চামড়া উঠিয়ে ফেলেছি। হাতের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর সেই সঙ্গে চলছে স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা।
ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় স্টোভের প্রাথমিক আগুনটা ধরে গেল। কিন্তু যে-ই কপার কয়েল উত্তপ্ত হয়ে কেরোসিনটা গ্যাস হওয়ার পালা এল, অমনি বাতাসের এক ঝাপটায় আগুন নিভে গেল।
সেই মুহূর্তের হতাশা বলে বোঝানো যাবে না। বিকেলে এক ঢোঁক পানির পর আর গলা ভেজানো হয়নি। চুলা জ্বালাতে না পারলে তুষার গলানো যাবে না। তুষার গলিয়ে পানি বানাতে না পারলে তৃষ্ণা মেটানোর মতো পানিও পাওয়া যাবে না। আর পানি না পেলে কিছু রান্নাও করা যাবে না। আর গরম ও ভারী কিছু না খেলে রাতের হিম ঠান্ডায় হাইপোথারমিয়া হয়েই অক্কা পেতে হবে। যেভাবে হোক চুলা জ্বালাতেই হবে। বেঁচে থাকার শর্ত এখন চুলা ধরানো।
এক অভিযানে আমার পা ভেঙে যাওয়ার পর বেশিক্ষণ একভাবে বসে থাকতে পারি না। পিঠ অসম্ভব ব্যথা করে। আর এই চুলা ধরাতে গিয়ে এক ঘণ্টার ওপর একভাবে ঝুঁকে বসে আছি। পায়ের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ ধরার সঙ্গে সঙ্গে পিঠে চিনচিনে ব্যথাটা ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছে। এখন আমাকে এর সঙ্গেও যুদ্ধ করা লাগবে। দাঁতে দাঁত চেপে আবার চেষ্টা করা শুরু করলাম।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একটি দেশলাই বক্স শেষ করে রেগেমেগে উঠে পড়লাম। আর সহ্য হচ্ছে না। একদিকে চুলা ধরানোর ব্যর্থতা, তেষ্টা, চরম ঠান্ডা, হাত জমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, অক্সিজেনের স্বল্পতা, আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ…সব মিলিয়ে আমি তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি।
রাগ, দুঃখ, হতাশা মিলেমিশে একাকার। সব ছুড়ে ফেলে দূরে একটা জায়গায় গিয়ে বসে রইলাম। তখনই ভাবনা এল, এখন কী? সবকিছু ফেলে তাঁবুতে ঢুকে ঘুমিয়ে যাব? পানি না খেলে তো পানিশূন্যতা হয়ে যাবে? কিছু খাওয়াও দরকার। কিছু না খেলে শরীরের ভেতরে তাপও তৈরি হবে না। হয়তো এই তাঁবুর ভেতরেই মরে পড়ে থাকতে হবে। চুপচাপ মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ভাবলাম। পরে দেখলাম শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই সারা রাত ধরে দরকার হলেও এই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
পাশে থাকা সোয়েব ভাই এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু দেখে যাচ্ছিলেন। একটু পরই আমার কাঁধে হাত রেখে পাশে এসে বসলেন। এরপর শুধু একটা কথাই বললেন, ‘চলেন, আরেকবার ট্রাই করি।’
দুজন মিলে আবার শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। চুলার ওপর তুষার এসে পড়ে চুলা ভিজিয়ে দিলে আর কিছু করা যাবে না। তাই সোয়েব ভাই ওপর থেকে একটা কালো পলিথিন ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি আবার চেষ্টা শুরু করলাম।
আমার চারদিকের পৃথিবীতে থাকা সব ঝুট ঝামেলা, এই পাহাড়, পর্বত, নিচের বরফ, ওপর থেকে নেমে আসা কুচি কুচি তুষার, চরম ঠান্ডা, জমে যাওয়া হাত, পিঠের অসহ্য ব্যথা সব ভুলে আমার তখন একটাই চিন্তা—আগুন! যেন ফের ভুল না হয় তার জন্য মনোযোগ দিয়ে কীভাবে কী করব, তার একটা ট্রায়াল দিয়ে নিলাম। আগের ভুলগুলো কেন হয়েছিল, সেটা আগে বোঝার চেষ্টা করলাম। পাথরের যে ফাঁক দিয়ে বাতাস আসছিল, সে ফাঁকগুলো বন্ধ করলাম। সবকিছু যখন নিজের আয়ত্তে চলে এসেছে বলে মনে হলো, তখন একটি কাঠি দিয়েই চুলাটি ধরে গেল। উজ্জ্বল নীল আলো আর তীব্র শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনে মনে হলো এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আর হতেই পারে না। একটা তৃপ্তির আনন্দ পুরো শরীরে অনুভব করতে পারছিলাম। সেদিনের তুষার গলানো পানির স্বাদের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
সে রাতে ভরপেট খেয়েদেয়ে, দুই লিটার গরম পানি থার্মাল ফ্লাস্কে ভরে, রাতের আকাশের ছায়াপথ দেখে, জীবন কতই না সুন্দর এ বিষয়ে একমত হওয়ার পরই আমরা ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
পরে আমি এ ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। এই জায়গায় যদি আমি তাঁবুতে বসে আরাম করতাম। আর অন্য কেউ আমাকে পানি এনে দিত, তাহলে কি আমার এতটাই ভালো লাগত।
পাহাড়ে নিজের টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করাই আমার কাছে অ্যালপাইনিজম। আমার যা ভালো লাগে, সেটা করতে আমার অন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকা লাগবে না। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সেটা করতে পারব। ‘আমি পারি’—নিজেকে এটা বলতে পারাই আমার কাছে অ্যালপাইনিজম। হাল না ছাড়া, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা, মনঃসংযোগ আর একাগ্রতা—এই তো আমার জন্য ‘অ্যালপাইনিজম’।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,