লেখক: তৌহিদী হাসান কুষ্টিয়া
সংবাদপত্রে নাম ও ছবি প্রকাশের বিষয়ে অনুমতি চেয়ে ফোন করলে ফুলপরী খাতুন বললেন, ‘নির্দ্বিধায় করতে পারেন।’ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীদের নামে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার সাহস কীভাবে পেলেন, এমন প্রশ্ন করা হলে মাত্র ১০ দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করা এই ছাত্রীর উত্তর, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। তাই কোনো অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করব না।’
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ফুলপরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে গেছেন।
এর আগে গতকাল দুপুরে ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে তদন্ত কমিটির কাছে তাঁর ওপর চলা নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী।
সেখান থেকে বেরিয়ে ফুলপরী কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা যা হয়েছে, সব তদন্ত কমিটির কাছে বলেছি। তাঁরা খুব মনোযোগের সঙ্গে আমার বক্তব্য শুনেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি, আমার সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বিচার পাব। ক্যাম্পাসে আমি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। তদন্তের প্রয়োজনে আবার আসব।’
১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে তাঁকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন ফুলপরী খাতুন। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ওই ছাত্রী গত বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
নির্যাতনের ঘটনায় এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের পাশাপাশি তদন্ত চলাকালে সানজিদা ও তাবাসসুম যাতে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারেন, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, তবে তদন্তের প্রয়োজনে কমিটি তাঁদের ডাকতে পারবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা ও তাঁর সহযোগী তাবাসসুম ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ছেড়ে যান।
ভুক্তভোগী ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে থাকেন। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় ওই ছাত্রী হাত তোলেন। হলে ওঠার বিষয়টি আগে তাবাসসুমকে না জানানোয় চটে যান তিনি। এরপর তাঁকে হলের কক্ষে (প্রজাপতি-২) দেখা করতে বলেন। তবে অসুস্থ থাকায় দেখা করেননি তিনি। ১১ ফেব্রুয়ারি ক্লাসে গেলে তাঁকে বকাঝকা করেন তাবাসসুম।
বাবা ও মামাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন পাবনার আটঘরিয়া থেকে ভ্যানচালক বাবা আতাউর রহমান ও মামা রবিউল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সকাল নয়টায় কুষ্টিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। পাবনা শহর থেকে প্রথমে কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর আসেন। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে আসেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ খেয়াঘাটে। এরপর ইজিবাইকে কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় পৌঁছান। সেখান থেকে বাসযোগে ২৪ কিলোমিটার দূরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। তখন দুপুর সাড়ে ১২টা।
সেখানে আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর জয়শ্রী সেন। সহকারী প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়িতে করে তাঁদের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে নিয়ে যান। এ সময় মূল ফটকের সামনে পুলিশের টহল গাড়ি ছিল।
প্রায় এক সপ্তাহ পর ক্যাম্পাসে ফেরা শিক্ষার্থী দুপুর সাড়ে ১২টায় তদন্ত কমিটির কাছে তাঁর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়া শুরু করেন। বক্তব্য নেওয়া হয় হলের প্রভোস্টের কক্ষে। লিখিত ও মৌখিকভাবে তাঁর বর্ণনা নেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। বিকেল পাঁচটার পর তদন্ত কমিটি প্রভোস্ট কার্যালয় থেকে বের হন। একই সঙ্গে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী বাবা ও মামার সঙ্গে বের হয়ে আসেন।
ফুলপরী খাতুন এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা খুবই মনোযোগ দিয়ে, ধীরে ধীরে ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। একপর্যায়ে হলের কোন স্থানে কীভাবে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে, তা সরেজমিনে দেখানো হয়। ছাত্রী বলেন, ‘হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা ও তাবাসসুম কী করেছেন, সেটা বলেছি। এই সময় আরও কয়েকজনের নাম বলেছি। তাঁরা হলেন ইশরাত জাহান ও হালিমা খাতুন।’
এই ছাত্রী বলেন, ‘কিছু কথা তদন্ত কমিটির সদস্যরা শুনেছেন। এ ছাড়া চার পৃষ্ঠার লিখিত দিয়েছি। আরও লিখিত দিতে বলা হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে সেগুলো লেখা হবে। তারপর দেব।’
এ সময় এই ছাত্রীর বাবা আতাউর রহমান বলেন, ‘একটাই দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত, সুষ্ঠু বিচার। কঠিন বিচার করতে হবে। যাতে বাংলাদেশে এ রকম কাজ আর কোনো জায়গায় না ঘটে। এমনকি পৃথিবীতেও না ঘটে।’
বিকেল পাঁচটার পর ফুলপরীসহ তাঁর বাবা ও মামাকে নিয়ে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রক্টর জয়শ্রী সেন একটি গাড়িতে করে ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর আলাউদ্দিন নগর এলাকায় পৌঁছে দেন। সেখান থেকে তাঁরা পাবনার আটঘরিয়ায় গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হন।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক যা বললেন
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রেবা মণ্ডল বলেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার আগে হলের কয়েকজন আবাসিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করেছি। সরেজমিন তদন্ত করতে মেয়েটিকে নিয়ে গণরুমের প্রজাপতি–১ ও দোয়েল–২ এবং ৩০৬ নম্বর কক্ষে গিয়েছি। এ ছাড়া হলের ডাইনিং রুমেও গিয়েছি। মেয়েটি এসব জায়গায় কখন কী হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছে।’
ফুলপরী খাতুন প্রথমে ৩০৬ নম্বর রুমে গেস্ট হিসেবে ওঠেন। আর প্রজাপতি–১ ও দোয়েল–২ গণরুমে তাঁকে নির্যাতন করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে রেবা মণ্ডল বলেন, ‘এ ঘটনা সম্পর্কে যারা যতটুকু জানে, তাদের বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। সেই সংখ্যাটা তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। ঘটনার সঙ্গে আপাতত সম্পর্কিত কয়েকজন মেয়ের নাম পেয়েছি। তাদের ডাকার জন্য প্রভোস্টকে বলা হয়েছে। সঠিক সময়ের মধ্যে সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আন্তরিকভাবে কাজ করা হচ্ছে।’
এ সময় রেবা মণ্ডলের সঙ্গে খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ইয়াসমিন আরা সাথী উপস্থিত ছিলেন।
একই সময়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল প্রভোস্টের করা তদন্ত কমিটিও তদন্তকাজ করে। হলটির প্রাধ্যক্ষ শামসুল আলম বলেন, ঘটনার পর ওই ছাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন তিনি। ওই কমিটি হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ডেকে পৃথকভাবে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আহসানুল হক।
প্রশাসন পদক্ষেপ নেয়নি
ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় কোনো জিডি বা মামলা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রক্টর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করতে পারে না। ব্যক্তি হয়তো মামলা করতে পারে। আর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটি রয়েছে, তারা সিদ্ধান্ত জানাবে। উপাচার্য ওই কমিটির সভাপতি।
হাইকোর্টের আদেশের পর মেয়েটিকে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়নি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, হাইকোর্টের আদেশ এখনো তাঁরা হাতে পাননি।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকীপন্থী হিসেবে পরিচিত। এ ব্যাপারে ফয়সাল সিদ্দিকী বলেন, প্রশাসন তদন্ত করছে। ছাত্রলীগও তদন্ত করছে। তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তার আগে কোনো ব্যবস্থা নয়।
শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত
এক দশক ধরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তঃকোন্দল চলছে। তাদের আধিপত্য বিস্তারে ভুক্তভোগী হয়েছেন অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীকে। তাঁদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। এ ছাড়া টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে নিয়োগপ্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে ছাত্রলীগকে মরিয়া থাকতে দেখা গেছে। ফলে সম্প্রতি কর্মচারী নিয়োগের বোর্ড বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক পদগুলোতে রদবদলের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব থাকে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের চাকরি দেওয়ার দাবিতে প্রধান ফটক অবরোধ, বিক্ষোভ ও উপাচার্যের কার্যালয়ে ভাঙচুর করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। এ নিয়ে প্রায় সময় শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাসহ সার্বিক বিষয়ে গণমাধ্যমে অনেক দিন ধরে লেখালেখি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মুঈদ। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে গেছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা। এ জন্য জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে সবার আগে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব ঘটনা আর ঘটবে না।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,