লেখক: সুরজিৎ রায় মজুমদার কানাডা
শিরোনামে ‘গণতান্ত্রিক’ কথাটা বার্ট্রান্ড রাসেলের অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘অভিজাতবাদী’ ও ‘গণতন্ত্রবাদী’দের মধ্যে বিবাদের মীমাংসার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেল কথাটা বলেছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগান কতখানি পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের হাতে, আর কতখানি ব্যবসায়মুক্ত, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে। তাঁর মতে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগান যেহেতু ব্যবসায়ীদের, সেহেতু তাঁদের ব্যবসায়িক প্রয়োজন এবং ফরমাশমতো পেশাগত শিক্ষা দিয়ে স্নাতক তৈরি করতে গিয়ে নিউম্যানের জ্ঞানভিত্তিক এবং লক ও মিলের উপযোগভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার মধ্যে সমন্বয় ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এটাই রাসেলের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের হানি।
রাসেলের গণতন্ত্র হলো অভিজাতবাদের জ্ঞান ও গণমানুষের পেশার মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমন্বয় সাধন। On Education বইয়ের শুরুতেই তিনি এ নিয়ে মতামত দিয়েছেন, ‘গণতন্ত্র বলিতে যদি ইহাই বুঝায় যে সকলের জন্য একই স্তর সুনির্দিষ্ট থাকিবে, তবে তাহার ফল হইবে মারাত্মক। কতক বালক-বালিকার বুদ্ধি অপরের চেয়ে বেশি এবং তাহারা উচ্চ শিক্ষা হইতে অন্যের তুলনায় অধিকতর সুফল লাভ করিতে পারে। কতক শিক্ষক উৎকৃষ্টতর শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, কাহারও বা স্বাভাবিক শিক্ষা ক্ষমতা অপরের চেয়ে বেশি। কিন্তু সকলের পক্ষেই উত্তম শিক্ষকের নিকট শিক্ষা লাভ করা অসম্ভব। সর্বোচ্চ শিক্ষাও সকলের জন্য বাঞ্ছনীয় মনে করা গেলেও বর্তমানে ইহা কদাচ সম্ভবপর নয়। কাজেই গণতান্ত্রিক নীতি অপপ্রয়োগ করিয়া বলা চলে, যেহেতু উচ্চ শিক্ষা লাভ সকলের পক্ষে সম্ভবপর নয় অতএব কাহাকেও ইহা দেওয়া উচিত নয়। এইরূপ নীতি গৃহীত হইলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি রুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং শত বৎসরের জন্য শিক্ষার সাধারণ স্তর নীচে নামিয়া যাইবে। বর্তমান মুহূর্তে mechanical equality-র বা যান্ত্রিক সমতার জন্য অগ্রগতি ব্যাহত করা উচিত হইবে না।
সামাজিক অবিচারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকিলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবান সুফল ও সম্ভাব্যতা যথাসম্ভব কম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকতা আনয়ন করিতে হইবে। অত্যন্ত সতর্কতার সহিত এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।’ অন এডুকেশন, বার্ট্রান্ড রাসেল। অনুবাদ: নারায়নচন্দ্র চন্দ। ১৯৯৭। পৃ. ১৭-১৮।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অভিজাতবাদীদের উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানের জন্য জ্ঞান এবং সে জ্ঞান ‘আলংকারিক’। আর গণতন্ত্রীদের উদ্দেশ্য হলো কার্যকরী জ্ঞান এবং সে জ্ঞান ব্যবহারিক। এ বিশুদ্ধ আলংকারিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক জ্ঞানের বিতর্ক বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার শুরু থেকেই চলে আসছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে উপনিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক অর্থনীতি। অন্তত দুটো ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত পরিষ্কার। প্রথমত, আয়ারল্যান্ড। ১৬৯১ থেকে আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার। একটানা শোষণের ফলে ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত ব্যাপক সময়জুড়ে দেখা দেয় ‘মহা আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষ’ (Great Irish Potato famine)। এক লাখ আইরিশ মারা যায় এবং অন্য এক থেকে দেড় লাখ সে সময় দেশ ছেড়ে চলে যায়। ফলে ইংরেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘ইম্পেরিয়াল কমপেনসেশন’ খেলা শুরু হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ আয়ারল্যান্ডের জনরোষ এবং দারিদ্র্য কিছুটা কমাতে এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার বাঁচিয়ে তুলতে ইংরেজ সিদ্ধান্ত নেয় আয়ারল্যান্ডে তিন তিনটে সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার, যার মধ্যে একটা আইরিশ ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি।
দ্বিতীয়টির কথা সবাই জানেন, কারণ সেটি আমাদের ‘ইম্পেরিয়াল কমপেনসেশন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু যেটি অনেকে জানেন না তা হলো আয়ারল্যান্ডের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি। কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি। ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ড এবং বাংলার লোকসংখ্যা ছিল প্রায় সমান ৪ কোটি ৫০ লাখ। এ সময় বাংলা প্রদেশ এবং ইংল্যান্ড দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের সংখ্যাও সমান ২৬ হাজার। কিন্তু পার্থক্য আছে। প্রথমত, ইংল্যান্ডের ২৬ হাজার আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে, কিন্তু বাংলার ২৬ হাজার শিক্ষার্থী শুধু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের ছাত্র আসে বাংলাসহ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ থেকে, কিন্তু বাংলার ছাত্র শুধু বাংলার। তৃতীয়ত, ইংল্যান্ডে ছাত্রীর সংখ্যা অনেক হলেও বাংলায় নেই বললেই চলে। চতুর্থত, যেহেতু বাংলায় সাক্ষরতার হার প্রতি ১০ জনে একজন, সে হিসাবে ইংল্যান্ডের তুলনায় বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যার অনুপাত বহুগুণ বেশি। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলার ২৬ হাজার ছাত্রের মধ্যে যেখানে ২২ হাজার ‘pursue purely literary courses which do not fit them for any but administrative, clerical, teaching and (indirectly) legal careers’, সেখানে ইংল্যান্ডের চিত্র পুরোটাই বিপরীত। ইংল্যান্ডে ২৬ হাজারের মধ্যে প্রায় ২২ হাজার ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘vocational training’ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলার এক বিপুলসংখ্যক বেকার এবং সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ‘Intellectual proletariat’ পাশ্চাত্যের বিপ্লবী ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সাম্রাজ্যের শাসকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল (Calcutta University Commission Report 1917-1919, Volume 1, Part 1, Chapter II, pages 19-21)। সুতরাং প্রথম কাজ হলো বাংলাকে ভাগ করে এ বিপ্লবী শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া। আর দ্বিতীয় কাজ হলো আয়ারল্যান্ডের মতো ‘ইম্পেরিয়াল কমপেনসেশন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে বেকারত্ব কমানোর চেষ্টা।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন উঠে আসে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি ‘Intellectual proletariat’-দের বেকারত্ব মোচনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তো এটাও সেই বৃহৎ ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’। নিউম্যান তাহলে কোথায় গেল? এ প্রশ্নের জবাবের আগে নিউম্যানকে একটু দেখে আসতে হবে।
হেনরি নিউম্যানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি এ কারণে বিশিষ্ট যে তিনি Locke ও Mill-এর উপযোগবাদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন। লক ও মিলের মতে, শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো বাজারের উপযোগী দক্ষতা সৃষ্টি, যা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। তাঁর লেখায় তিনি সর্বদা প্রবলভাবে ‘পরিমাপযোগ্য শিখনফল’ ধারণাটির বিরোধিতা করে বরং এ কথাই বলতে চেয়েছেন যে শিক্ষাকে আসলে গতানুগতিক মূল্যায়নের অতীত এক প্রসারিত দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করতে হবে। নিউম্যান যদিও বৃত্তিমূলক পেশার বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি চাইতেন যে বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলাম এমনভাবে করা উচিত, যার মধ্যে বহু বিচিত্র অধ্যয়নের সুযোগ থাকবে, যেন শিক্ষার্থী ও গবেষকরা মানব মনের কঠিনতম দার্শনিক প্রশ্নগুলো, সামাজিক সমস্যাগুলো এবং বৈজ্ঞানিক প্রশ্নগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে নিউম্যানের উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতিটি এখনে যোগ করা হলো—
It is a great point then to enlarge the range of studies which a University professes, even for the sake of the students; and, though they cannot pursue every subject which is open to them, they will be the gainers by living among those and under those who represent the whole circle. This I conceive to be the advantage of a seat of universal learning… An assemblage of learned men, zealous for their own sciences, and rivals of each other, are brought, by familiar intercourse and for the sake of intellectual peace, to adjust together the claims and relations of their respective subjects of investigation. They learn to respect, to consult, to aid each other. (Newman cited in Lanford, Michael. “The Idea of a University “. The Literary Encyclopedia. First published 02 April 2019 [https://www.litencyc.com, accessed 01 August 2019.]).
কথাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ততার সমার্থক এবং নিউম্যানের এ উক্তি এই প্রতিধ্বনিই করে যে ‘the very name of University is inconsistent with restrictions of any kind’.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার আগে আবারও একটু রাসেলে যেতে হচ্ছে। আলংকারিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার সমন্বয়ের দৃষ্টিতে তিনি বলছেন, ‘লাঙল প্রয়োজনীয়, কেননা ইহা দ্বারা মাঠ চাষ করা হয়। শুধু মাটি ভাঙার জন্যই চাষ করার কোনোও সার্থকতা নাই। ইহা উপকারী এই জন্য যে, ইহার ফলে জমি বীজ বুনিবার যোগ্য হয়। বীজ বপন করা প্রয়োজনীয় কাজ, যেহেতু ইহার ফলে শস্য উৎপন্ন হয়। শস্য প্রয়োজনীয়, কারণ ইহা হইতে প্রস্তুত হয় খাদ্য। খাদ্য প্রয়োজনীয়। কারণ ইহা জীবন রক্ষা করে। কিন্তু জীবনের নিজস্ব মূল্য থাকা উচিত। জীবন যদি কেবল অন্য জীবনের উপায়স্বরূপ হয় তবে ইহাকে মোটেই প্রয়োজনীয় বলা চলে না।…প্রয়োজনীয় কথাটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করিলে শিক্ষা প্রয়োজনীয় মনে করিতে হইবে কি-না সে প্রশ্ন উঠে না। শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিবেচিত হইবে, কারণ শিক্ষাদান ব্যাপারটিই কাম্য উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য লাভের উপায় মাত্র (অন এডুকেশন, বার্ট্রান্ড রাসেল। অনুবাদ: নারায়নচন্দ্র চন্দ। ১৯৯৭। পৃ. ১৭-১৮)।
এবার যদি আমরা শিক্ষিত প্রলেতারিয়েতের বেকারত্ব দূর করার জায়গায় ফিরি, তাহলে নিউম্যান দূরে চলে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সরকারের মনে যা–ই থাকুক না কেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশন এবং পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে নিউম্যান মাথায় রেখে কাজ করেছেন, তার প্রমাণ রয়েছে তাঁদের রিপোর্টে। কমিশন মোট ২৩টি প্রশ্নের এক সেট প্রশ্নমালা ৬৭১ ব্যক্তি অথবা সংগঠনের কাছে পাঠিয়ে মতামত সংগ্রহ করে। এসব প্রশ্নের অনেকগুলোতে নিউম্যানের ধারণার ছাপ চোখে পড়ে, বিশেষভাবে ২, ৯, ১০, ১৬ এবং আরও কিছু প্রশ্নে। এই প্রশ্নগুলোতে নিউম্যানের আলোকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা, পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা কমানো, স্নাতকদের ‘Intellectual curiosity’ বাড়ানোর বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের মতামত চাওয়া হয়েছে (Calcutta University Commission Report 1917-1919, Volume 1, Part 1, Chapter II, pages 4-9)।
দ্বিতীয়ত, গোড়া থেকেই কৃষি এবং শিল্পের মতো ব্যবহারিক বিষয়কে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, এ কথা স্পষ্ট যে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নিছক ‘বৃহৎ ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট’-এ পরিণত হয়নি। আর সর্বোপরি, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব স্তরেই কমবেশি চালু রয়েছে।
এবার শেষ কথা বলতে হয়, আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের অর্থের মুখাপেক্ষী নয় কখনো। সুতরাং পুঁজির যূপকাষ্ঠে নিউম্যানের উন্মুক্ততাকে বাধ্য হয়ে বলিদানের বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন কখনো আসেনি। এদিক থেকে, রাসেলের দৃষ্টিতে, ইউরোপ বা আমেরিকার চেয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে ওঠার জন্য অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তবে বাস্তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতখানি গণমুখী, শিক্ষার্থীবান্ধব এবং ‘গণতান্ত্রিক’ সে প্রশ্ন এবং তা খতিয়ে দেখার প্রাসঙ্গিকতা অবশ্যই থেকে যায়।
লেখক: ইংরেজির অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কানাডাপ্রবাসী।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,