লেখক:ড. এন এন তরুণ।
‘আমাদের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন’—১৯৯১ সালে সরকার গঠন করার পর খালেদা জিয়ার কেবিনেটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমানকে কটাক্ষ করে সংসদে দাঁড়িয়ে কথাটি বলেছিলেন সে সময়ের বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। আজ তিরিশ বছর পর তাঁর কথাটি আবার কীভাবে এবং কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সেই আলোচনায় পরে আসছি।
হেনরি কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন তাঁর প্রথম মেয়াদকালের পুরোটা সময়। এ সময় তাঁর কর্মতৎপরতা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও বেশি।
দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর নিক্সন কিসিঞ্জারকে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলেন, তখন প্রথম দিন অফিসে ঢুকেই তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কিসিঞ্জার যা বলেছেন, তার বাংলা তর্জমা এ রকম: ‘চেয়ার বসেই আমার প্রথম মনে পড়ল আমার প্রধান প্রতিপক্ষ, প্রবাদপ্রতিম, ধুরন্ধর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর কথা, যিনি ’৫৭ সাল থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য অনেক সফলতা নিয়ে এসেছেন। তাঁর কথা ভেবে আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।’
পররাষ্ট্রনীতি কতটা কঠিন একটা বিষয়, তার আরেকটা উদাহরণ দিই: বিল ক্লিনটন রোডজ স্কলারশিপ নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে এসেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি অক্সফোর্ড গিয়ে তিন মাসে পররাষ্ট্রনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ১০০টা বই পড়ে শেষ করেছিলাম।’
১৯৬২ সালে কিউবান ‘মিসাইল ক্রাইসিস’খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া দ্বন্দ্ব যখন চরমে, তাঁর প্রায় সব উপদেষ্টা যখন সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিক্ষা দেওয়া পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তখন প্রেসিডেন্ট কেনেডি জানতে চাইলেন, সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভের মনে আসলে কী আছে, তিনি কী ভাবছেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, ক্রুশ্চেভ চান তুরস্কের সীমান্ত এলাকায় রাশিয়ার দিকে তাক করে রাখা ইউএস মিসাইল যেন সরিয়ে ফেলা হয়। কেনেডি ঠিক তা-ই করলেন এবং বিনিময়ে ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকেও মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলেন। এভাবে একটা পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করলেন কেনেডি।
১৯৬৩ সালের ১০ জুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেনেডি বললেন, ‘শান্তি কোনো জাদুবিদ্যা দিয়ে অর্জন করা যায় না। শান্তি একটি প্রক্রিয়া, যা ক্রমাগত অব্যাহত রাখতে হয়, শান্তি হলো সমস্যা সমাধানের একটি উপায়, অন্য পক্ষের সঙ্গে একটি গঠনমূলক আত্মনিয়োগ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।’ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক এবং এ বিষয়ে বহু গ্রন্থের প্রণেতা, অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাক্স প্রায় একই সুরে বলেন, ‘অন্য পক্ষ কী ভাবছে, তা জেনে-বুঝে বিবেচনায় নিয়ে সর্বোত্তম কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।’
কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা একটি কঠিন কাজ। এখানে লব্ধ জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। ধী-শক্তি, সজ্ঞা, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, বাগ্মিতা, বাগাড়ম্বর, দ্ব্যর্থক বা ঘুরিয়ে কথা বলার যোগ্যতা, রসবোধ, গল্প বলার ক্ষমতা, হাসিমুখ, ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য ইত্যাদি গুণাগুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। চাণক্য বলছেন, ‘মধু তিষ্টতি জিহবাগ্রে হৃদয়ে তু হলাহলম’, অর্থাৎ অন্তরে বিষ থাকলেও মুখে থাকতে হবে মধুর বাক্য। মধুর বাক্য বর্ষণ করে শ্রোতাকে মুগ্ধ করে ফেলতে হবে।
ঘুরিয়ে কথা বলা সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিই: ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের দায় নিয়ে তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পদত্যাগের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি দুটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘কেউ কখনো একটি মৃত কুকুরকে লাথি দেয় না’; ‘শত্রুর সংখ্যা দিয়ে একজন ভালো মানুষ চেনা যায়’।
রসবোধের তিনটি উদাহরণ দিই: আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। একবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে মধ্যরাতে শহীদ মিনারে গেলেন ফুল দিতে। ছাত্ররা তাঁকে ওপরে তুলে প্যান্ট খুলে ফেলল। সেই দৃশ্য পরদিন সব পত্রিকায় ছাপা হলো। সাংবাদিকেরা গেলেন এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে। তিনি বললেন, ‘ওরা আমারে চিনতে পারে নাই। অন্য লোক ভেবে এটা করেছে।’
এ কে ফজলুল হক কথার মধ্যে মাঝেমধ্যে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতেন। সাংবাদিকেরা যখন বললেন, ‘স্যার, আপনার বক্তব্য ওই অশ্লীল শব্দসহ ছেপে দেব কিন্তু!’ ফজলুল হক বললেন, ‘ছাপো যাইয়া। মোরে যাঁরা ভোট দেয়, হেরা পেপার পড়ে না।’ সাংবাদিকেরা হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
মাওলানা ভাসানী একবার পল্টন ময়াদানে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ভাইসব, চাউলের দাম বেড়েছে এত টাকা, লবণের দাম এত টাকা, আটার দাম এত টাকা… (মঞ্চে পায়ের কাছে বসা দলের জেনারেল সেক্রেটারি জাদু মিয়াকে দেখিয়ে) বললেন, আর মদের দাম কত বেড়েছে, তা অবশ্য আমাদের যাদু ভালো বলতে পারবে!’
সুচতুর রাজনীতিকেরা অনেক বেকায়দা অবস্থায় কোনো কথাই বলেন না। যেমন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি বিষয়ে প্রশ্ন করতে করতে সাংবাদিকেরা নিক্সনকে বারবার বিদ্ধ করা সত্ত্বেও তাঁর মুখ থেকে একটা কথাও বের করা যায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর মতো ধুরন্ধর রাজনীতিকও অনেকবার এ রকম করেছেন। ইংরেজিতে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘শি ওয়াজ টাইট-লিপড’। ইন্দিরা এটা শিখেছেন তাঁর বাবা, নেহরুর কাছ থেকে।
ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর বেরিয়ে এলে সাংবাদিকেরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেন। এক বিদেশি সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘এবার কি তাহলে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছেন?’ বঙ্গবন্ধু, অতি সংক্ষেপে মাত্র দুটি শব্দ উচ্চারণ করলেন ‘নট ইয়েট’ অর্থাৎ ‘এখনই নয়’। ‘নো’ বললে দেশের জনগণ হতাশ হবে, মনোবল ভেঙে যাবে আর ‘ইয়েস’ বললে গ্রেপ্তার হতে পারেন। তাই বললেন, ‘নট ইয়েট’। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব এটি।
এ কে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেলেন কোন বিবেচনায়—এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গভীর গবেষণার বিষয় হতে পারে। এখানে দোষটা মোমেন সাহেবের নয়। সরকারের দায়িত্ব সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় স্থাপন করা, যাতে সীমিত মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়।
মোমেন সাহেবের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য (পারসোনাল ট্রেইট) এই বয়সে অতিক্রম করবেন কীভাবে? তিনি যা, তাই-ই। ‘র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দূর করতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়রাও মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছে’ বা ‘ভারতে গিয়ে আমি বলেছি, এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে’— এসব দেশের জন্য চরম অবমাননাকর। নিষেধাজ্ঞা দূর করতে ভারত কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, জানতে চাইলে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘প্রশ্নটি আমাকে নয়, ড. মোমেনকেই করুন’। এভাবে বাংলাদেশের মাথা হেট করে দিয়েছেন তিনি।
এ রকম অসংখ্য উক্তি যেমন ‘রাশিয়ার তেল, গম কিনতে ভারতের কাছে বুদ্ধি চায় বাংলাদেশ’, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো’—জনমানসের মধ্যে যে কী পরিমাণ চাপ তৈরি করে সেটা সরকার বুঝতে পারে কিনা জানি না।
সরকার বা সরকারি দলের নেতারা কি সত্যি কথাটা শুনতে চান, নাকি যা শুনতে তাঁরা পছন্দ করেন সেটা শোনেন? তাঁরা কি পত্রিকার সম্পাদকীয় বা কলামগুলো পড়ে দেখা প্রয়োজন মনে করেন? করলে কি আর এ রকম নিয়োগ হয়? বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মাথা এভাবে হেট হয়?
*****ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ:সেপ্টম্বর ০৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,