লেখক:মেহেদি রাসেল।
একবার একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি এ রকম—ফিরিঙ্গিদের দেশে ছিল এক নাস্তিক। লোকটা যে সে নাস্তিক নয়, যাকে বলে একেবারে পাঁড় নাস্তিক। মাঝেমধ্যে খেপে গিয়ে ঈশ্বরের নামে আজেবাজে কথা বলতেও কসুর করত না সে। লোকটার পরকালের চিন্তায় তার বন্ধুদের কপালে চার–পাঁচটা করে স্থায়ী ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল। তারা তাকে ধর্মের পথে আনার জন্য ফন্দিফিকির কম করেনি। দেশ–বিদেশের বিখ্যাত সব তীর্থে পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এরপর ঘটনাক্রমে লোকটা সাত দিনের জন্য বাংলাদেশে ঘুরতে এল।
এই দেশের জলবায়ুর কী গুণ! মাত্র সাত দিন কাটিয়ে তার আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়! নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সে ধর্মের গুণগান প্রচার করতে লাগল। এমন পরিবর্তনে তার বন্ধুরা অবাক, পরিবারের লোকজন অবাক, এমনকি পাড়াপড়শি পর্যন্ত অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল দমন করতে না পেরে বন্ধুরা বড় বড় চোখ মেলে তার কাছে জানতে চাইল, ব্যাপারটা কী? এই সাত দিনে সে কী এমন অলৌকিক বস্তুর দর্শন লাভ করেছে যে ধর্মপালনে এখন সে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে! লোকটি বলল, ‘এত দিন আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করে অনেক ভুল করেছি। বাংলাদেশে গিয়ে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়েছে। আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেছে। ঈশ্বর যদি না–ই থাকেন তাহলে এত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও দেশটাকে কে টিকিয়ে রেখেছ?’
সত্যিই, এত অনিয়ম এত দুর্নীতি, এত স্বজনপ্রীতির পরও দেশটা যে টিকে আছে, এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার বটে। টিআইবির রিপোর্টে অনেক দিন ধরে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের রোল নম্বর যে ১ হচ্ছে না তাঁর কারণ সম্ভবত বাংলাদেশের দুর্নীতি কমে যাওয়া নয় বরং অন্যরা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজার বলে কথা। তবে প্রথম না হলেও প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় একই জায়গায় আছে।
টিআইবি সম্প্রতি একটি জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হচ্ছে, সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবার (খানা)। এই রিপোর্ট ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক বছরের। আরও মজার তথ্য আছে জরিপে, বলা হয়েছে ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আমাদের দেশের ৪ ভাগের ৩ ভাগ মানুষ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না।
ঘুষকে মোটামুটিভাবে আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেতে পেরেছি। আমি কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁদের ছেলেমেয়ে যে সরকারি চাকরিতে ঘুষ খায়, সেটা নিয়ে তাঁদের কোনো অভিযোগ আছে কি না। তাঁরা প্রত্যেকে উল্টো প্রশ্ন করেছেন, চাকরিটা পেতে তাঁদের যে মোটা অঙ্কের টাকা এককালীন ঘুষ দিতে হয়েছে, এখন ঘুষ না খেলে সেটা উঠবে কী করে? যুক্তির কথা বটে, ফলে এর ওপরে আর কথা চলে না। বোঝা গেল, অভিযোগ তো নেই–ই বরং নৈতিক সমর্থন আছে। এ যেন ঘুষের দুষ্টচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঘুষ একবারেই ‘মামুলি ঘটনা’ আমাদের দেশে। এতই মামুলি যে ৩১ আগস্ট রিপোর্টটির খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন দুর্নীতির শিকার পরিবারের সংখ্যা ৭১ শতাংশ এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না, কেননা বাস্তবে এটি আরও অনেক বেশি হবে।
যে খাতগুলোর ওপর জরিপে দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো হলো, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমিসেবা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা সংস্থাসহ মোট ১৭টি সেবা খাত। এই সেবাগুলো এত দরকারি যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের এই সেবা গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। এগুলো অত্যাবশ্যকীয়। আসলে এগুলোই সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত খাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে সবচেয়ে ‘দুর্নীতিযুক্ত’।
আইনশৃঙ্খলা সংস্থা সর্বাধিক ঘুষ গ্রহণ করে টিআইবির তালিকায় ‘কৃতিত্বের সঙ্গে’ প্রথম হয়েছে। অর্থাৎ আইনি কাজের জন্য গিয়েই সবচেয়ে বেশি বেআইনি অর্থ দিতে হচ্ছে মানুষকে। কী মর্মান্তিক অবস্থা!
ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তারা তাহলে কোথায় যাবে? যারা নিয়ম করে তিন বেলা খেতেই পায় না, তাদের কী উপায় হবে? তবু উপায়হীন হয়ে, আশায় বুক বেঁধে অসমর্থ মানুষও মাঝে মাঝে আইনের আশ্রয় নিতে যায়। কিন্তু সেটা যখন ব্যর্থ হয় তখন শ্রীপুরের হযরত আলীর মতো মানুষেরা আত্মঘাতী হন। ২০১৭ সালে হযরত আলী তাঁর আট বছরের মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঘুষকে নিয়ম বানিয়ে ফেলা মানুষের তবু বোধোদয় ঘটে না। নির্দোষ, রিক্ত মানুষের রক্তের দাগ কোনোই ভাবান্তর ঘটায় না তাদের। উল্টো দিন শেষে ঘুষ নেওয়ার হার ও পরিমাণ দুটোই বাড়ে।
এর আগের জরিপে (২০১৭ সালে) যেখানে ৬৬ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয়েছে, এবার দিতে হয়েছে প্রায় ৭১ শতাংশকে। এই যে ঘুষ প্রদানের শতকরা হার বেড়ে গেল, এতেই প্রমাণিত হয় আমাদের ‘সক্ষমতা’ বেড়েছে। আবার আগের জরিপে যেখানে গড়ে প্রতি পরিবারকে ঘুষ দিতে হয়েছে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা, সেখানে এবার দিতে হয়েছে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। এখানেও আমাদের ‘উন্নতি’ চোখে পড়ার মতো।
তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল, নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে এবং সে কারণে আমরা ঘুষ বেশি দিতে পারছি। উন্নয়নের মহাসড়কে আমাদের দুর্নীতির উন্নয়নও বর্ধিষ্ণু ফি–বছর। কে জানে, একেই হয়তো আমরা নাম দিয়েছি ‘সামগ্রিক উন্নয়ন’।
****মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,