লেখক: মহিউদ্দিন
দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু গত দুই দশকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়েনি। ফলে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা।
সরকারি সংস্থা তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) হিসাব বলছে, দিনে এখন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। ঘাটতি মোকাবিলায় দিনে এখন ১০০ কোটি ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে, যা মোট সরবরাহের ৩০ শতাংশের বেশি। ঘাটতি প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিল্প ও বিদ্যুতে চাহিদা বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানি আরও বাড়াতে হবে। জ্বালানি বিভাগও আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন জোর নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর পরপর ছোট একটি-দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। অনুসন্ধানে বাড়তি জোর না দেওয়াই সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তিনি বলেন, কম সম্ভাবনা নিয়েও অনেক দেশ এর চেয়ে বেশি অনুসন্ধান চালায়।
২০৩০ সালে মজুত শেষের শঙ্কা
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, দেশে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয় ১৯৫৫ সালে, সিলেটে। এখন মোট গ্যাসক্ষেত্র আছে ২৭টি। এর মধ্যে ২০টি থেকে উৎপাদন চলছে। গ্যাসের মোট প্রমাণিত মজুত ২৮ টিসিএফ (লাখ কোটি ঘনফুট)। এর মধ্যে সাড়ে ১৮ টিসিএফ তোলা হয়েছে, মজুত আছে আর সাড়ে ৯ টিসিএফ। বর্তমানে বছরে প্রায় এক টিসিএফের মতো গ্যাস তোলা হয়। ফলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র না পাওয়া গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মজুত শেষ হয়ে যেতে পারে। আর আগামী বছরগুলোতে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমবে।
অনুসন্ধানে জোর নেই
স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সরকারের জোর কম। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি করার পরও বাংলাদেশ কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারেনি।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত ২০ বছরে দেশে মাত্র ২৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে চারটি। নোয়াখালীর সুন্দলপুর, কুমিল্লার শ্রীকাইল ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ক্ষেত্রগুলোতে মজুত তেমন বেশি ছিল না। বেশির ভাগই তোলা হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ভোলায় একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে, তবে উৎপাদন শুরু হয়নি।
বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এরপর ২০১৪ সালে একটি বহুমাত্রিক জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আজ পর্যন্ত শুরুই করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, ভারত ও মিয়ানমার ইতিমধ্যেই সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার করেছে।
বাংলাদেশ চারটি বিদেশি কোম্পানিকে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ দিয়েছিল। এর মধ্যে কনোকো ফিলিপস, সান্তোস-ক্রিস এনার্জি ও দাইয়ু মাঝপথে চলে গেছে। ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ শিগগিরই একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করবে বলে কথা রয়েছে।
আরও আমদানির পরিকল্পনা
পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত, উৎপাদন, অনুসন্ধান ও সম্ভাবনা নিয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত একটি প্রক্ষেপণ প্রতিবেদন তৈরি করতে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর নতুন কর্মসূচি নেওয়া হবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, দেশে তিন বছরের মধ্যে দিনে আরও ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। আমদানি বাড়াতে স্থলভাগে একটি ও ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এখন রয়েছে দুটি টার্মিনাল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের দেশ হিসেবে এখন গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানির বিকল্প নেই।
সংকট তৈরি করা হয়েছে
আজ ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। ২০১০ সাল থেকে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৪৫ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে (তখনকার ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেন। পরে এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বড় নির্ভরস্থল হয়ে ওঠে।
সংকট বাড়তে থাকায় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে আমদানি করা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের গড় দাম পড়ে নয় ডলার। আর দেশে উৎপাদিত গ্যাসের দাম পড়ে দুই থেকে তিন ডলার। বাংলাদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগ কমিয়ে ধীরে ধীরে সংকট তৈরি করা হয়েছে এলএনজি আমদানির জন্য।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,