রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেসব যুক্তি দিয়েছে, তার মধ্যে একটি ছিল, সেখানে রাজু ভাস্কর্য থাকার বিষয়টি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা রাজু ভাস্কর্যের সঙ্গে অস্থায়ী এই ভাস্কর্যের বিরোধ নেই। সন্ত্রাসের প্রতিবাদ হিসেবে ছাত্ররা যেভাবে রাজু ভাস্কর্য গড়ে তুলেছিলেন, সেই একই চেতনা থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের এই অস্থায়ী ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের এই ভাস্কর্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত চারুকলার ছাত্র শিমুল কুম্ভকার জানিয়েছেন, বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করার পর মিছিল–সমাবেশের বাইরে ভিন্নভাবে তাঁরা প্রতিবাদ জানানোর চিন্তা করেছিলেন। এরপরই তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে প্রতিবাদের শৈল্পিক ভাষা হিসেবে পেরেকবিদ্ধ রক্তাক্ত গীতাঞ্জলি হাতে বিষণ্ন মুখের রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। মুখে টেপ লাগানো এই রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, অবরুদ্ধ করা হয়েছে লেখকের কণ্ঠস্বর।
গত মঙ্গলবার বিকেলে ভাস্কর্যটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে রাখার পর বুধবার রাতে সেটি সরিয়ে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরদিন ভাস্কর্যের ভাঙা অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পড়ে থাকতে দেখেন শিক্ষার্থীরা। সেই ভাঙা অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা শনিবার আবার ভাস্কর্যের কাঠামোটি দাঁড় করিয়েছেন আগের জায়গায়।
প্রতিবাদের প্রতীকী এই ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, তারা যে কাজটি করেছে, তাতে বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়নি। যে ভাস্কর্যটি আছে আমাদের, দেশের অর্জন এবং ইতিহাসের প্রতীক (রাজু ভাস্কর্য), সেটিকে অবমাননা করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ এটি সরিয়ে দিয়েছে।’
::পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যে বিধিনিষেধের প্রতিবাদ
দেশের সব পর্যায়ের মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধার প্রতিবাদে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে::
প্রক্টর গোলাম রাব্বানী ইতিহাসের প্রতীক হয়ে ওঠা যে রাজু ভাস্কর্যের কথা বলেছেন, সেটি তৈরি হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের গোলাগুলির মধ্যে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল বের করেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের একদল নেতা–কর্মী। সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ওই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা মইন হোসেন রাজু। তাঁর স্মরণে এবং সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা ধরে রাখার প্রত্যয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও মইন হোসেন রাজুর বন্ধুদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য। ১৯৯৭ সালে এই ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়।
এই ভাস্কর্য নির্মাণের সময়ও আপত্তি উঠেছিল। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয়, মূল আপত্তিটা তুলেছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৬-৯৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আসলাম খান। রাজু ভাস্কর্য স্থাপনে অন্যদের সঙ্গে তিনিও যুক্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। আসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রথমে টিএসসি এলাকার ডাসের পাশে যেখানে মইন হোসেন রাজু গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। পরে একটি বড় আকারের ভাস্কর্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন যেখানে ভাস্কর্যটি আছে সেখানে স্থাপন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গেলে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখান। কিন্তু রাস্তাটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের। সেখান থেকে আপত্তি তোলা হয়। তবে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়।
::‘গুম হয়ে গেছেন’ রবীন্দ্রনাথ।::
আসলাম খান জানান, ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন তখনকার উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। পরবর্তী সময়ে এটি উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী। আর এটি উন্মোচন করেছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। আসলাম খান বলেন, ভাস্কর্যে একজন নারীর মুখ আছে। সে মুখটি কার হবে, তা নিয়েও কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সব ছাত্রসংগঠন, গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়।
রাজু ভাস্কর্যের পাশ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতীকী ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে এই ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা
রাজু ভাস্কর্যের পাশ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতীকী ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে এই ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা ছবি: প্রথম আলো
সেখানে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের বিষয়ে আপত্তির কারণ তুলে ধরে প্রক্টর গোলাম রাব্বানী শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা প্রতিবাদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এটার ধরন এবং যেভাবে করেছে, সেটা নিয়ে আপত্তি। প্রথমত গোপনে এটি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখানে একটি নান্দনিক ভাস্কর্য আছে, এর পাশেই এটি দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তৃতীয়ত, বিশ্ববরেণ্য কবিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এতে যে সৌন্দর্য ও সম্মান আশা করা হয়, সেটি হয়নি। সার্বিকভাবে এটি অনুমতিবিহীন অবৈধ কাজ হয়েছে।’
তবে রাজু ভাস্কর্যের পাশে রবীন্দ্রনাথের এই ভাস্কর্যকে প্রতিবাদের শক্তিশালী প্রতীকী ভাষা হিসেবে দেখছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ। তিনি শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অস্থায়ী এই ভাস্কর্য সেখানে রাখা হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য। এটা স্থায়ী কিছু নয়। লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকের মতপ্রকাশে বাধার প্রতিবাদ হিসেবে এটা সেখানে রাখা হয়েছে। প্রকারান্তরে এটা রাজু ভাস্কর্যের প্রতিবাদী চরিত্রকেই তুলে ধরছে। এখানে রাজু ভাস্কর্য অবমাননার কিছু নেই। এই ভাস্কর্য হয়ে উঠতে পারত মুক্তচিন্তা আর মতপ্রকাশের ওপর সব বাধা, দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী চরিত্রের প্রতীক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এর বাইরে যেসব ভাস্কর্য রয়েছে, তার প্রায় সব কটিই মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে কলা ভবনের সামনে স্থাপন করা হয় অপরাজেয় বাংলা। এটি স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। এ ছাড়া টিএসসির সড়ক দ্বীপে ১৯৮৮ সালে শামীম শিকদার নির্মাণ করেন ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্যটি। ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে আছে ‘স্মৃতি চিরন্তন’। এর নামফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শহীদের নাম রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়াও বায়ান্নর ভাষা দিবস, ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান প্রাধান্য পেয়েছে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,