Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

আফগানিস্তানে বুদ্ধ

Share on Facebook

লেখক: সুদীপ্ত পাল।

।। আফগানিস্তানে বুদ্ধ ।। (প্রথম পর্ব)

ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে দশরাজার যুদ্ধে ভারত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে দশ রাজা লড়াই করেছিল তার মধ্যে এক রাজার গোষ্ঠী ছিল পক্থাস যাদের অনেকে পাক়তুন বলে অনুমান করে। হেরোডোটাসের বর্ণনায় আমরা পাই পাকটিয়ানদের কথা যারা আফগানিস্তানের দক্ষিণ দিকে বাস করত, যে অঞ্চলকে হেরোডোটাস আরাকোসিয়া বলেছেন আর আবেস্তীয় ভাষায় হরউবতী (বৈদিক ভাষায় সরস্বতী- সম্ভবতঃ হেলমন্দ নদী) বলা হত। পাক্টিয়ানরা পাক়তুন হতে পারে। আরাকোসিয়ার উত্তরে ছিল কম্বোজ ও গান্ধার, আর আরও উত্তরে বাহ্লীক। বাহ্লীকের গ্ৰীক নাম ব্যাক্ট্রিয়া, আধুনিক নাম বাল্খ- এটি উত্তর আফগানিস্তানের একটি শহর। আরাকোসিয়া, কম্বোজ, গান্ধার, বাহ্লীক- এই সবকটি জায়গা মিলিয়ে মোটামুটিভাবে আজকের আফগানিস্তান। বাহ্লীক বা ব্যাক্ট্রিয়ার কিছুটা অংশ অবশ্য উজবেকিস্তানে আর গান্ধারের বেশীরভাগটা এখন পাকিস্তানে।

উত্তর আফগানিস্তানের দশলি গ্ৰামে প্রাগার্য সভ্যতার নিদর্শন বড় আকারে পাওয়া যায়। এটি বৃহত্তর ব্যাকট্রিয়া মার্জিয়ানা আর্কিওলোজিকাল কম্প্লেক্সের (BMAC- বিম্যাক) অন্তর্গত। এই বিম্যাক নগরসভ্যতা আমু দরিয়া নদীর অববাহিকায়- এখনকার চারটি দেশ জুড়ে এর বিস্তার ছিল- উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তান। এই সংস্কৃতি আজ থেকে চার সহস্রাব্দ আগের। এই সংস্কৃতিতে হাজার হাজার সীলের অস্তিত্ব বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক সক্রিয়তার আভাস দেয়।

এই বিম্যাক সংস্কৃতি মূলতঃ প্রাচীন ইরানীয় চাষীদের বংশধরদের তৈরি [4], তবে এখানে আদি ভারতীয় (অর্থাৎ আন্দামানীয়) জিনের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত সংমিশ্রণ দেখা যায় [4]- অল্প কিছু মানুষের মধ্যে হলেও। এটি হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগের ইঙ্গিত দেয়। আবার স্তেপের পশুপালকরা, যারা বৈদিক আর্যদের পিতৃক্রমের পূর্বপুরুষ, তারাও ধীরে ধীরে মধ্য এশিয়া থেকে এই সংস্কৃতিতে এসে মিশতে থাকে। বৈদিক আর প্রাগার্য ভারতীয়দের একে অপরের সঙ্গে সংমিশ্রণ সিন্ধু উপত্যকায় শুরু হলেও, প্রথম পরিচয়ের কিছু আভাস বিম্যাকে আছে।

দশলি গ্ৰাম ও আশেপাশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ছবিতে পাবেন [2]। বিভিন্ন সীল ও তাবিজ থেকে ধর্মবিশ্বাসের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। ছবিতে দিলাম ডানাওয়ালা সিংহ এবং দাঁড়িআলা পক্ষীমানবের ছবি। হয়তো ভবিষ্যতে এরা হয়ে উঠবে সাঁচীর তোরণের ডানাওয়ালা সিংহ আর জরথুষ্ট্রীয়দের পক্ষীমানব ফরবহর। আবার না-ও হতে পারে।

একে একে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের বিকাশ আফগানিস্তানে হয়। প্রাগার্য ধর্ম, বৈদিক হিন্দুধর্ম, আবেস্তীয় ধর্ম, জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, বেদ-পরবর্তী হিন্দুধর্ম (বিশেষ করে শৈব ও বৈষ্ণব), মানিকেইজ়ম, নেস্টরিয়ান খৃষ্টধর্ম, তেংরিধর্ম, নুরিস্তানি সনাতন ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম। এদের মধ্যে অনেক ধর্মের প্রাথমিক বিকাশ আফগানিস্তানে ধরলে ভুল হয় না। প্রাথমিক বৈদিক সাহিত্যের বেশ কিছুটা এখানে রচিত, জরথুষ্ট্রের সাম্ভাব্য জন্মস্থানগুলির একটি হল বাল্খ অর্থাৎ বাহ্লীক শহর। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাপ্ত বৈষ্ণব স্থাপত্য ও শিলালেখ হল বিদিশার হেলিওডোরাস পিলার- যা তৈরি করিয়েছিলেন ব্যাক্ট্রিয়া থেকে আগত গ্ৰীক ভাগবত হেলিওডোরাস। বৈদিক ভাষাকে যিনি সংস্কৃত রূপ ও নাম দেন, সেই পাণিনির জন্ম খাইবার পাক়তুনওয়া অঞ্চলে বলে অনুমিত। সংস্কৃতের সবচাইতে কাছের ভাষা “খোয়ার” এখনও খাইবার পাক়তুনওয়ার খো উপজাতির লোকেরা বলে। খাইবার পাক়তুনওয়া এখন পাকিস্তানের অংশ।

বুদ্ধ কীভাবে ও কবে আফগানিস্তানে পৌঁছলেন?

অনেকের মতে বুদ্ধের জীবনকালেই। বুদ্ধের প্রথম গৃহী শিষ্যদ্বয় ছিলেন ত্রপুষ ও ভল্লিক – দুই বণিক। হিউএনসাঙের বর্ণনা অনুযায়ী এঁরা বাহ্লীক দেশের এবং এঁরাই বাহ্লীক বা বাল্খে বুদ্ধের বাণী নিয়ে আসেন। ষষ্ঠ শতকে হিউএনসাঙ অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন বাল্খ শহরের বিহারগুলোতে, তখন এরকম একটা কাহিনী উনি শোনেন[1]। ভল্লিক শব্দটা বাহ্লীক থেকে এসেছে বলে অনুমিত। কিন্তু চীনের তুর্কী ( উইগুরিস্তান) অঞ্চলের তুরফানে আবিষ্কৃত তুর্কী সূত্র অনুযায়ী ওরা দুজন তুর্কী[1], আবার অন্য অনেক কাহিনীতে এরা উৎকলের লোক বা মায়ানমারের। মোট কথা এই কিংবদন্তীর সত্যতা বিচার এখন সম্ভব নয়। তবে বুদ্ধের জীবদ্দশায় না হলেও অশোকের সময়ে এবং আরো পরে বিশেষ করে ইন্দো-শক ও কুষাণ যুগে বৌদ্ধ ধর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই অঞ্চলে বড় আকারে পাওয়া যায়।

অশোকের কান্দাহার শিলালেখ:

এটি গ্ৰীক ও আরামাইক দুই ভাষায় ও দুই লিপিতে লেখা। আলেকজান্ডারের আসার পর ঐ অঞ্চলে গ্ৰীক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তার আগে ইরানীয় আকিমেনিড সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল আরামাইক। যদিও আরামাইক হল আরবি আর হিব্রুর মত সেমেটিক ভাষা যার সঙ্গে ইরানীয় ভাষাগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, তবে আরামাইক ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বিস্তারের কথা মাথায় রেখেই একে আকিমেনিড সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা করা হয়েছিল। অশোকের লিপির আরামাইক অনেকটা পারসিক মিশ্রিত। যাই হোক, এই লেখতে দেখা যায় অশোক ইউসিবিয়া অর্থাৎ ধর্মের কথা উল্লেখ করেছেন। ইউসিবিয়া গ্ৰীক দর্শনে একটি বহু ব্যবহৃত শব্দ। ধর্ম শব্দটার সঠিক বিদেশি প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। অশোকের লেখকরা ইউসিবিয়া শব্দটাকেই বেছে নিয়েছিলেন ধর্ম শব্দটার গ্ৰীক তর্জমা হিসেবে। ধর্মের আরামাইক প্রতিশব্দ হিসেবে তাঁরা বেছে নেন qšyṭ’ mhqšṭ যার মোটামুটিভাবে অর্থ হল “সত্য”। এই লেখতে বুদ্ধের ব্যাপারে বিশেষ কিছু নেই, তবে দুই শতকের মধ্যেই বুদ্ধ এই অঞ্চলে আসবেন।

পরের পর্বে দেখব বুদ্ধের সঙ্গে হারকিউলিসের সাক্ষাৎ, বুদ্ধের সঙ্গে অহুরমজদার মিলন, বুদ্ধের প্রথম মানবমূর্তি ও আরো অনেক কিছু। বুদ্ধের প্রথম মানবরূপ আফগানিস্তানেই নির্মিত হয়েছিল।

।। আফগানিস্তানে বুদ্ধ ।। (দ্বিতীয় পর্ব)
© সুদীপ্ত পাল।

গান্ধার-বহ্লিক অঞ্চলে তখন প্রতি শতকে এক নূতন রাজনৈতিক পালাবদল, আর প্রত্যেকটা পালাবদলের সঙ্গে বেড়েছে বুদ্ধের গুরুত্ব। অশোকের মৃত্যুর আরো এক শতাব্দী পরের কথা। দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকে প্রায় পুরো আফগানিস্তান তখন গ্রীকদের অধীনে। এই ইন্দো-গ্ৰীক শাসকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মিনান্দার বা মিলিন্দ। তাঁকে ঘিরে লেখা হয় বৌদ্ধ সাহিত্য মিলিন্দ পঞ্হো (মিলিন্দ প্রশ্ন)। মিলিন্দ বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে তাঁর শবদাহের পর তাঁর দেহাস্থি বিতরণ করা হয়, যা বৌদ্ধ রীতির সঙ্গে মেলে। গ্ৰীকরা শবদাহের পর অস্থিভস্ম একটা ভাণ্ডে রাখত, এভাবে বিতরণ করত না। মিলিন্দ ও দ্বিতীয় মিলিন্দের মুদ্রায় আটটি স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র পাওয়া যায়, গ্ৰীক দেবদেবী জিউস ও নাইকি- এদের দেখা যায় ধর্মচক্র সহ। এগুলো বৌদ্ধ প্রভাব।

গ্ৰীকদের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের পরিচয় অবশ্য মিলিন্দের দুই শতক আগেই হয়েছিল। গ্ৰীক দার্শনিক Pyrrohএর জীবনীতে দেখা যায় তিনি আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে আসেন ও ফিরে গিয়ে সংশয়বাদী দর্শনের প্রবর্তন করেন। ভারতীয় নগ্ন সাধুদের (Gymnosophists) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। যদিও এটা জৈন, অজ্ঞানবাদী বা আজীবকদের ইঙ্গিত বহন করে, তবে তাঁর দর্শনে বৌদ্ধ ত্রিলক্ষণের ধারণার প্রভাব পাওয়া যায়। অতএব পাশ্চাত্য দর্শনে সংশয়বাদ বৌদ্ধ প্রভাব হবার ভালমতই সম্ভাবনা আছে।

ইন্দো গ্ৰীকদের পর এল ইন্দো-শকদের রাজত্বকালে (প্রথম পূর্বশতক), তারপর এল কুষাণরা (প্রথম শতক)। শকরা ইরানীয় আর্যজাতি, তাদের কিছু শাখা মধ্য এশিয়া থেকে এসে আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম ভারতে রাজত্ব শুরু করে। শকদের এই শাখাগুলিকে ইন্দো-শক বলা হয়।

ইতিহাসের প্রথম বুদ্ধ-প্রতিকৃতি:
সাঁচী আর ভরহুত- ভারতের প্রাচীনতম দুটি উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ শিল্প- দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতক নাগাদ নির্মিত। দু’জায়গাতেই বুদ্ধজীবনী প্রদর্শিত হয়েছে- তবে বুদ্ধকে অদৃশ্য রেখে- কখনও ছাতার আড়ালে- কখনও শূন্য বজ্রাসন দেখিয়ে (সাঁচীর বুদ্ধমূর্তিগুলো পরবর্তী যুগের সংযোজন)। প্রথম মানবমূর্তিরূপে বুদ্ধ এলেন প্রথম সাধারণ পূর্বশতক নাগাদ। এখনও অবধি প্রাপ্ত তাঁর প্রাচীনতম প্রতিকৃতি হল বিমরান কাস্কেট।

বুদ্ধের দেহাবসান ও দাহক্রিয়ার পর তাঁর দেহাস্থিগুলি রাজারা আট ভাগে ভাগ বাটোয়ারা করে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সেগুলোর উপরে স্তূপ নির্মাণ করেন। পরে অশোক সেই স্তূপগুলির উৎখনন করে ৮৪০০০ ভাগ করে এগুলিকে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেন, এবং এইভাবে আগামী কয়েকশো বছরে আরও নতুন নতুন স্তূপ গড়ে ওঠে। আফগানিস্তানের জালালাবাদের কাছে এমনই একটি স্তূপ- বিমরান স্তূপ। তার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেছে ধাতুনির্মিত কাস্কেট- বুদ্ধের দেহাস্থি রাখার বাক্স। এর গায়ে দেখা যায়- বুদ্ধকে উপাসনা করছেন ইন্দ্র ও কমণ্ডলু হাতে ব্রহ্মা। অধুনা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এই শিল্পকৃতিটি আনুমানিক প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের। এর থেকে পুরোনো বুদ্ধ-প্রতিকৃতি এখনও পাওয়া যায়নি। এটি বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চার-পাঁচশ বছর পরে তৈরী।

“বিমরান কাস্কেট” ইন্দো-শক রাজা আজেস প্রথম বা দ্বিতীয়ের আমলে তৈরি। ইন্দো-শকরা বৌদ্ধ ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিত। আরেকজন ইন্দো শক রাজা ইন্দ্রবর্মনের তৈরি একটা বুদ্ধদেহাস্থি রাখার ভাণ্ড (বাজৌর কাস্কেট)- তার মধ্যে খরোষ্ঠি লিপিতে লেখা তথ্যাবলী আমরা পাই।

আফগানিস্তানের প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহারগুলি:
আফগানিস্তান তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে এক টুকরো গ্ৰীস ছিল হড্ডা। গ্ৰীকদের যুগ তখন আর নেই- শকরা এসেছে, তারপর কুষাণরা। তবে কুষাণযুগে হড্ডায় যে পরিমাণ গ্ৰীক শিল্পরীতির প্রভাব দেখা যায় তাতে বোঝা যায় গ্ৰীক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ছিল। হড্ড মানে হাড়। বুদ্ধের দেহাস্থি এখানে রাখা ছিল, তাই শহরের এই নাম। জালালাবাদের কাছেই এটি অবস্থিত। (এই নিয়ে দ্বিতীয়বার জালালাবাদের কথা এল, কারণ এই শহরটির অবস্থান কাবুল নদীর উপর আর খাইবার পাসের শেষপ্রান্তে, তাই এক অর্থে এটি আফগানিস্তানের প্রবেশদ্বার আর বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র)।

হড্ডায় সহস্রাধিক শিল্পকৃতি পাওয়া গেছে, সবই গ্ৰীক শৈলির। বুদ্ধও তার ব্যতিক্রম নন। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতক অবধি এই মূর্তিগুলি তৈরি, আর পঞ্চম শতক অবধিও ভালমত গ্ৰীক প্রভাব ছিল।

বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল দ্বিতীয় শতকের একটি বড় মাপের বুদ্ধমূর্তি যার (নিজের) ডানপাশে হারকিউলিস (তিনি বজ্রপাণিরূপে- হাতে বজ্র) আর বামপাশে গ্ৰীকদেবী টাইকি (tyche) । এই দেবীর হাতে কর্নুকোপিয়া – অর্থাৎ একটা মোষের শিঙের মত পাত্র যাতে ফলমূল রাখা থাকে- আজকের লক্ষ্মীর ঝাঁপির সঙ্গে তুলনীয়। পরবর্তীকালে গুপ্তযুগের মুদ্রায় লক্ষ্মীকে এমন কর্নুকোপিয়া হাতে দেখা যায়। টাইকি সমৃদ্ধির দেবী- সব গ্ৰীক-রোমান নগরীর অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন। সম্ভবতঃ গ্ৰীক টাইকি আর বৌদ্ধ গজলক্ষ্মী (যাঁর প্রথম আবির্ভাব ভরহুতের বৌদ্ধস্তূপে) মিলে হিন্দু লক্ষ্মী। আবার এই টাইকিই হয়ে উঠেছিলেন বৌদ্ধ দেবী হারিতি।

অন্য বুদ্ধমূর্তিতে যেরকম তাঁকে হিন্দু দেবদেবী পরিবৃত দেখা যায় (যেমন বিমরান কাস্কেটে ব্রহ্মা ও ইন্দ্র) এখানে তেমনি তিনি গ্ৰীক দেবদেবী পরিবৃত।

এই অপূর্ব সুন্দর ত্রয়ীমূর্তিটি ১৯৯২ সালে তালিবানরা ধ্বংস করে। বামিয়ানের এক দশক আগে। এই মূর্তিগুলো ছিল হড্ডার তাপা শোতোর বৌদ্ধ বিহারে। এই বিহারটির সূচনাকাল হল ইন্দো শক রাজা দ্বিতীয় আজেসের সময়ে, তবে মূর্তিগুলি কুষাণযুগের। এই বিহারটি সর্বাস্তিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চাস্থল ছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম প্রাপ্ত পুঁথি হল হড্ডায় প্রাপ্ত সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ দর্শনের পুঁথি। গান্ধারী ভাষায়, খরোষ্ঠি লিপিতে লেখা। এখন ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে পাবেন।

ঐযুগে গান্ধার অঞ্চলের আরো অনেক ভাস্কর্য আছে যেখানে বুদ্ধ বজ্রপাণি হারকিউলিসের সঙ্গে আছেন (ছবিগুলো দিলাম)। বজ্র কীভাবে চিনবেন? দুদিকে স্ফীত মাঝে সরু যে ডমরুর মত অস্ত্রটা ওটাই বজ্র। সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িআলা পেশীবহুল শরীরের দেবতাটি হলেন হারকিউলিস। তবে কেউ কেউ ওনাকে জিউস বলে মনে করে। আবার হিন্দু সংস্কৃতিতে ইন্দ্র হলেন বজ্রপাণি এবং তিনিও অনেক জায়গায় বুদ্ধের সহচর। ছবির ভাস্কর্যগুলি কিছু আফগানিস্তানের, কিছু পাকিস্তানের খাইবার পাক়তুনখোয়ায় প্রাপ্ত। গান্ধার বলতে মূলত খাইবার পাক়তুনখোয়া আর আফগানিস্তানের কাবুল নদী উপত্যকাকে বোঝায়।

আজকের পর্বে গান্ধারে বুদ্ধ, হারকিউলিস, টাইকি, হারিতি, লক্ষ্মী, গ্ৰীক দর্শন, ভারতীয় দর্শন সবাইকে এসে মিশতে আমরা দেখলাম- এর থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানস্থল ছিল।

এর পরের পর্বে দেখব কণিষ্কর উদ্যোগে বুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ আর বুদ্ধ-মজ়দা। আরো পরে বামিয়ানে প্রাপ্ত পৃথিবীর প্রাচীনতম তৈলচিত্র নিয়ে আলোচনা হবে।

।। আফগানিস্তানে বুদ্ধ ।। (তৃতীয় পর্ব)
© সুদীপ্ত পাল।

জয়ী সম্রাট বিজিত রাজ্যের ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে যায়- এটাই নিয়ম। কণিষ্ক বারাণসী জয়ের পরেও নিশ্চয়ই তাইই করেছিলেন, কিন্তু তিনি বারাণসীরাজের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন বিশেষ দুটি অমূল্য সম্পদ। এক, বুদ্ধর ভিক্ষাপাত্র। দুই, রাজদরবারের এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও দার্শনিককে তিনি চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের রাজধানীতে। তাঁর নাম অশ্বঘোষ। তাঁর রচিত মহাকাব্য বুদ্ধচরিত ছিল সবচেয়ে সমাদৃত বুদ্ধজীবনী, সর্বাস্তিবাদ দর্শনে অশ্বঘোষের বিশেষ অবদান আছে, মহাযানধর্মের আদি প্রবক্তাদের একজন তিনি। এটাই কণিষ্ককে আলাদা করে অন্য সম্রাটদের থেকে।

💮বুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ:
কণিষ্ককে বৌদ্ধরা বলে দ্বিতীয় অশোক। বুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণে কণিষ্কের ভূমিকা অশোকের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আর অশোক সর্বধর্মসমন্বয় করেছিলেন ভারতীয় ধর্মগুলির মধ্যে, কিন্তু কণিষ্ক সেটাকে নিয়ে যান আন্তর্জাতিক স্তরে। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল গান্ধার-বহ্লিকের আন্তর্জাতিক অবস্থানের জন্য (যে অবস্থান ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের অনেক সংকটের কারণও হয়েছে)।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যপথ ছিল রেশমপথ। তার উপরে উত্তর আফগানিস্তানের বহ্লিক বা বাল্খ শহর। এখান থেকে তিনদিকে রাস্তা যায়- একটা নেমে আসে সিন্ধু উপত্যকায়, আরেকটা চীনের দিকে, আরেকটা পশ্চিম দিকে। ইরানের পার্থিয়ান সাম্রাজ্য এই রেশম পথে নানারকম অবরোধ তৈরি করে। সেই সুযোগে কুষাণরা পাশ্চাত্যমুখী বাণিজ্যকে বাল্খ থেকে পথ ঘুরিয়ে কাবুল-পেশোয়ার হয়ে নিয়ে যায় সিন্ধু অববাহিকার সমুদ্রবন্দরগুলোর দিকে। এটাকে ঘিরে বাল্খ শহরের প্রতিপত্তি বাড়ে, আর কুষাণ সাম্রাজ্য, বিশেষ করে গান্ধার আরো বেশি করে বিশ্বসংস্কৃতির মিলনস্থল হয়ে ওঠে।

কুষাণরা তোখারিয়ান আর্যজাতি ছিল। প্রথমদিকে ঐ অঞ্চলের পুরোনো রীতি অনুযায়ী তারা সরকারি কাজে গ্ৰীক ভাষাই ব্যবহার করত। ১২৭ অব্দে কণিষ্ক “আর্য” ভাষাকে সরকারি ভাষা করেন। রবতক শিলালিপিতে বর্ণিত এই আর্যভাষা ছিল ইরানীয় আর্য পরিবারের ভাষা, যেটাকে ব্যাক্ট্রিয়ান ভাষাও বলা হয়, এবং এখনকার পাশতো ভাষার সঙ্গে কিছু মিল আছে।

কুষাণরা শৈব, ইরানীয় ও বৌদ্ধ ধর্ম পালন করত। কুষাণদের শিবের মৃৎফলক নিয়ে অন্য একটি ধারাবাহিকে বিশদ আলোচনা করেছি (এখানে খালি ছবি দিচ্ছি)। কণিষ্কও বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি সব ধর্মের দেবদেবীকে নিজের মুদ্রায় স্থান দেন।

কুষাণ মুদ্রার দেবদেবীদের মধ্যে ছিলেন-
ইরানীয়: আরদোকশো, ননা (দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপ মধ্যভারতে সৃষ্ট হলেও সিংহবাহিনী রূপে ননার অবদান থাকতে পারে), মিত্র, দ্রুঅস্প, ক্ষত্রবৈর্য, অহুরমজ়দা ইত্যাদি।
গ্ৰীক: জিউস, হেলিওস (সূর্য), নাইকি ইত্যাদি।
বৌদ্ধ: বুদ্ধ, মৈত্রেয় ইত্যাদি।
শৈব: ওম্মো (উমা), ওইশো (শিব), স্কন্দকুমার, গণেশ।

এঁরা মুদ্রার দেবদেবী। মুদ্রার দেবদেবীরা সরসারি রাজকীয় সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া এই দেবদেবীদের অনেককে ভাস্কর্য আর মৃৎফলকের রূপেও পাওয়া যায়।

কণিষ্কের বিখ্যাত রবতক শিলালিপি পাওয়া যায় আফগানিস্তানের সুর্খ কোটালের কাছে। এখানে সাকেত, উজ্জয়িনী সহ বিভিন্ন শহর জয়ের কথা আছে। যে দেবদেবীদের তিনি বন্দনা করেছেন তাঁরা হল:
জ়িরি (শ্রী), ওম্মা (উমা), বিশাখ, মিহির, কুমার (কার্তিক), মাসেনো (মহাসেন- কার্তিক) ও বিভিন্ন ইরানীয় দেবতা- ননা (সিংহবাহিনী), অহুরমজ়দা, ফরো ইত্যাদি। এখানে ননার মন্দির বানানোর উল্লেখ আছে।

কণিষ্কর বিশেষ অবদান হল চীনে বৌদ্ধধর্মকে পৌঁছে দেয়া। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী চীনে পৌঁছন এবং এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন লোকক্ষেম। তাঁর আগেও অবশ্য রেশমপথে ও চীনে বৌদ্ধ ধর্মের সামান্য বিস্তার হয়েছিল। কণিষ্ক চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতির (council) আয়োজন করেন কাশ্মীরে, সারা ভারতের প্রায় পাঁচশ ভিক্ষুকে একত্র করে। এটি সর্বাস্তিবাদী সংগীতি ছিল। থেরবাদীদের চতুর্থ সংগীতি আলাদা, সিংহলে আয়োজিত হয়। ততদিনে বৌদ্ধধর্মে ভাগাভাগি শুরু হয়ে গেছে। এই সর্বাস্তিবাদের অভিধর্ম সাহিত্য পরে মহাযানের ভিত্তি হয়ে ওঠে (সর্বাস্তিবাদ আর মহাযান এক নয়, এদের বিরোধও ছিল, তবে সর্বাস্তিবাদ মহাযানের উৎসগুলির একটি)। সর্বাস্তিবাদকে কণিষ্ক চীনে প্রসার করেন, যা পরে জাপান ও কোরিয়ায় পৌঁছয়। অন্যদিকে থেরবাদ শ্রীলঙ্কা থেকে সমুদ্রপথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ছড়ায়। অশোক অবশ্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আগেই বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু চীনে ও মধ্য এশিয়ার তুর্কী দেশগুলোতে বুদ্ধকে পৌঁছে দেন মূলতঃ কণিষ্ক।

পৃথিবীর যত দেশে মহাযান প্রচলিত আছে- চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম- সর্বত্রই বেশীরভাগ মহাযানী বৌদ্ধ একসাথে দুটো ধর্মপরিচয় দেয়। বিশেষ করে জাপানে বৌদ্ধদের বেশিরভাগই শিন্টোধর্মাবলম্বীও। তেমনি কোরিয়ায় অনেকেই শিন্ডো ও বৌদ্ধধর্মের যুগ্ম অনুসারী। চীন ও ভিয়েতনামে মহাযানীরা ঐ দেশগুলোর সনাতন ধর্মের সঙ্গে যুগ্মভাবে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। এটা কিন্তু থেরবাদী প্রধান দেশে দেখা যায় না- শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া, মায়ানমার। এই দেশগুলোর বৌদ্ধধর্মে স্থানীয় ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব থাকলেও নিজেকে দুটো ধর্মের মানুষ বলে কেউ পরিচয় দেয় না। লেখকের ব্যক্তিগত মত হল মহাযানী ধর্মে এই একাধিক ধর্ম অনুসরণ করার প্রবণতা কিছুটা কুষাণদের বহুধর্মানুগামিতা থেকে শুরু, কারণ কুষাণরাজ্য থেকেই বৌদ্ধধর্ম চীনে, আর সেখান থেকে ভিয়েতনাম, জাপান ও কোরিয়ায় গেছে। কণিষ্কের মুদ্রায় বুদ্ধের থেকে অনেক অনেক বেশি উপস্থিতি ইরানীয় দেবদেবীদের, এছাড়া শৈব ও গ্ৰীকধর্মের মুদ্রাও তাঁর আছে। কণিষ্ক বৌদ্ধ দর্শনকে গণ্ডীবদ্ধ ধর্ম হিসেবে দেখেননি।

💮বুদ্ধমজ়দা:
অহুরমজ়দা জরথুষ্ট্রীয় দেবতা। বুদ্ধমজ়দা তাহলে কে?
তৃতীয়-চতুর্থ শতকে আফগান-সীমান্তবর্তী উজবেকিস্তানের কারা-তেপে বিহারের দেয়ালচিত্রে এঁকে পাই। এই বুদ্ধের কাঁধ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের শিখা। মাথার কাছে লেখা বুদ্ধমজ়দা।[3] এছাড়া আফগানিস্তানের কপিশা শহরের কাছাকাছি প্রাপ্ত ঐযুগের কিছু বুদ্ধমূর্তিতে এরকম অগ্নিশিখা পাওয়া যায়। অগ্নি জরথুষ্ট্রীয় ধর্মে উপাস্য। এই আগুনের উপস্থিতি আর নামের মধ্যে মজ়দা ইঙ্গিত দেয় জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রণের। সেটা স্বাভাবিক, কারণ কুষাণরা অনেকটাই ইরানীয় ধর্মগুলির সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের সহবত গড়ে তুলেছিল, আর দুটি ধর্মই রেশমপথে প্রভাবশালী ছিল। পরবর্তী যুগের চীন ও তিব্বতের বুদ্ধদের এরকম পিঠে অগ্নিশিখা সহকারে দেখলে বুঝবেন জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের প্রচ্ছন্ন প্রভাব।

এছাড়া আরেকটি হারিয়ে যাওয়া ধর্ম বুদ্ধ, জরথুষ্ট্র ও যীশুকে একত্রিত করেছিল তার নাম মানিকেইজম। কণিষ্কর এক শতাব্দী পর ইরানে এই ধর্মের প্রবর্তক মানি। এই ধর্মে বুদ্ধ আদিমানবের মাতা, অহুরমজ়দা আদিমানব, তাঁর পাঁচ সন্তান পঞ্জরোশন (পাঁচ রোশনাই)- মাটি, জল, আকাশ, বায়ু, আগুন। এটি দ্বৈতবাদী ধর্ম। প্রাগিসলামিক যুগে রেশমপথের চারটি প্রধান ধর্মের একটি ছিল এটি। অন্য তিনটি ছিল- বৌদ্ধ ধর্ম, জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম, নেস্টরিয়ান খৃষ্টধর্ম।

💮কুষাণ যুগের আফগানিস্তানের বৌদ্ধ মঠসমূহ:
বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল-
১. জালালাবাদের নিকটবর্তী তেপে শোতোর বিহার – আগের পর্বে আলোচিত।
২. জালালাবাদ অঞ্চলের আহনপোষ বিহার। এখানে প্রচুর রোমান মুদ্রার উপস্থিতি এই বিহারটির ও অঞ্চলটির বাণিজ্যিক গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়।
৩. বাল্খে কণিষ্ক নির্মাণ করেন নববিহার (নূতন বিহার)। ফার্সি ভাষায় নওবহার।

💮কণিষ্কর পর:
কুষাণ পরবর্তী যুগে বহ্লিক অঞ্চলের বিহারগুলোর (বাল্খের নববিহার, উজবেকিস্তানের তারমিজ়) সক্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকে, তবে গান্ধার (কাবুল, জালালাবাদ ও খাইবার পাক়তুনখোয়া) অঞ্চলের বিহারগুলোর সক্রিয়তা কমতে থাকে। শ্বেতহূণদের আক্রমণ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার, অর্থনৈতিক মন্দা- বিভিন্ন কারণে। হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতকে ভ্রমণের সময় গান্ধারসহ প্রায় পুরো ভারত ভূখণ্ডে অধিকাংশ বিহারের অবক্ষয় দেখতে পান। তবে আফগানিস্তানের গভীর অভ্যন্তরে একটি জায়গায় এসে তিনি দেখতে পান সেখানে দশটি বিহার খুব সক্রিয় অবস্থায় তো আছেই, উল্টে সেখানে নূতন নূতন বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ হচ্ছে। পর্বতভেদী, অমিতদেহী দুটি বুদ্ধমূর্তিকে অলংকৃত করা হয়েছে সোনা দিয়ে। এটিই ছিল বামিয়ান!

পরের পর্বে দেখব আফগানিস্তানে তুর্কশাহি আমলে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুদ্ধার।

।।আফগানিস্তানে বুদ্ধ।। (চতুর্থ পর্ব)
© সুদীপ্ত পাল

আফগানিস্তানের বৌদ্ধদের কাছে ভারতীয়দের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত দুটি কারণে:
এক, কণিষ্ক ও লোকক্ষেম শুধু বুদ্ধকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যাননি, ভারতীয় সংস্কৃতিকেও নিয়ে গিয়েছিলেন জগৎসভায়।
দুই, কাবুলের বৌদ্ধ তুর্কিশাহী রাজারা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে আরব খিলাফতের ভারতে পৌঁছানোকে প্রতিরোধ করে রেখেছিল।

💮 টানাপোড়েনের চারশ বছর:
সপ্তম শতকে প্রতিবেশী ইরানে বিশাল এক পরিবর্তন হয়। আরবে ইসলামের জন্ম হয়, ইরানের প্রায় অপরাজেয় সাসানীয় সাম্রাজ্যের আকস্মিক পতন হয় আরব খিলাফতের হাতে, আর প্রায় পুরো ইরান ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। এরপর ৬৬০ সালে রশিদুন খিলাফত সাম্রাজ্য ও ইসলাম প্রবেশ করে আফগানিস্তানের পশ্চিম অংশে। তুর্কিশাহিরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পূর্ব আফগানিস্তানে। রশিদুন খিলাফতের পর আরব থেকে আসে আব্বাসীয় খিলাফত। এরা কাবুল পেরিয়ে খাইবার পাক়তুনখোয়া অবধি চলে আসে, তবে তুর্কিশাহিরা ৭১০ সালের মধ্যে আবার এই অঞ্চলকে পুনরুদ্ধার করে এবং ৮১০ সাল অবধি খিলাফতকে কাবুলে প্রবেশ করা থেকে প্রতিহত করে রাখে।

তুর্কিশাহি আমলে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ হয়। ইসলাম আসার আগেই শ্বেতহূণদের সন্ত্রাস, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার, অর্থনৈতিক মন্দা এসব কারণে বৌদ্ধ ধর্ম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কুষাণদের পর আফগানিস্তানে এসেছিল কুষাণশাহীরা, এরা ইরানের সাসানীয়দের সামন্ত রাজা ছিল। সাসানীয়রা বৌদ্ধদের ঘাঁটায়নি, তবে পৃষ্ঠপোষকতাও দেয়নি কারণ ওদের সরকারি ধর্ম ছিল জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম। এটাও বৌদ্ধধর্ম স্তিমিত হয়ে পড়ার কারণ। অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ছিল পঞ্চম শতকে রোমের পতন আর ষষ্ঠ শতকে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার প্লেগ।

💮 নূতন বুদ্ধ, নূতন রূপ:
তুর্কিশাহিরাও বিদেশি, মধ্য এশিয়া থেকে আগত। এদের সংস্কৃতিতে চীনের তাং সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল। এটা একটা কারণ তাদের বৌদ্ধধর্ম প্রীতির। তুর্কশাহিরা এনেছিল নূতন শিল্পরীতিও, আর সেটাও চীনের থেকে অনুপ্রাণিত। কণিষ্ক পাঁচশো বছর আগে যে আমানত চীনে পাঠিয়েছিলেন তা অন্যরূপে আবার ফিরে এল তাঁর নিজের দেশে। চীন সেটাকে রক্ষা করেছিল, নিজের মত করে তাকে সাজিয়েছিল। চীনের ঐ অঞ্চলে কতটা প্রভাব ছিল সেটা বোঝা যায় এই থেকে যে সাসানীয়রা শেষ চেষ্টা হিসেবে তাং সম্রাটদের দ্বারস্থ হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মপ্রচার ছিল চীনের সফ্ট পাওয়ার।

মোটামুটিভাবে পঞ্চম শতকেই গ্ৰীক অনুপ্রাণিত গান্ধার শিল্পের যুগ শেষ হয়ে যায়। তুর্কীরা নিয়ে এল নূতন শিল্পরীতি, এক নূতন রূপের বুদ্ধ। এই বুদ্ধের চেহারা অনেকটা তুর্কো মোঙ্গোলদের মতই। সাজপোশাকও আলাদা। মধ্য এশিয়ার মত তিন-পাতা আকারের শাল তাঁর গায়ে (ছবিতে দেখানো হয়েছে)। গায়ের অলঙ্কারাদিও অন্যরকম। পাথরের থেকে পোড়ামাটির ব্যবহার বেশি।

মনে রাখতে হবে মহাযানধর্ম গণ্ডিবদ্ধ ধর্ম নয়। তুর্কীশাহীরা তাদের মুদ্রায় স্থান দিয়েছিল আজ়র সহ বিভিন্ন ইরানীয় দেবদেবীদেরকেও। সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন জরথুষ্ট্রীয়রা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, ইরানে যখন মূর্তিপূজার কথা ভাবাই যায় না, তখনও ইরানের প্রাচীন দেবদেবীরা আফগানিস্তানে টিকে ছিলেন, তুর্কীশাহীদের মুদ্রায়। (ছবিতে একটি মুদ্রায় তেগিন শাহের সঙ্গে ইরানীয় দেবতা আজ়র – মাথার পিছনে আগুন লক্ষণীয়, অন্যটায় অগ্নি ও তার দুই উপাসক)। জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম ইরানের বাইরে উজবেকিস্তানে আরেকটু দীর্ঘ সময় টিকে ছিল।

শ্বেতহূণদের আক্রমণের সময় থেকেই মধ্য এশিয়ার তুর্কো মোঙ্গোলরা আফগানিস্তানে আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে তোখরিস্তানের (অতীতের বহ্লিক) তোখর ইয়াবগু বংশ উল্লেখযোগ্য ছিল যারা সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে রাজত্ব করেছিল। এদের মধ্যে থেকেই তুর্কীশাহীদের উত্থান। এখনও আফগানিস্তানের অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তুর্কো মোঙ্গোল বংশগতি ও চেহারার আদল দেখা যায়- যেমন হাজারা ও আইমাক – এরা জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। তবে এরা অনেক পরবর্তী যুগের পরিযান ও সংমিশ্রণের ফল।

তুর্কিশাহি রাজা ফ্রোমো কেসরো (৭৩৯-৮০০ অব্দ আনুমানিক) আরব খিলাফতের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন- তাঁর বীরগাথা রচিত হয়েছিল তিব্বতে মহাকাব্য রূপে- “এপিক অফ কিং গেজ়র” নাম দিয়ে।

তুর্কিশাহিদের সময়ে আফগানিস্তানের ঘোরবন্দ অঞ্চলের ফোন্ডুকিস্তান বিহার, গজনির কাছে তাপা সর্দার বিহার, কাবুলের কাছে তাপা নরেঞ্জ বিহার বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। অনেক বৌদ্ধ ভাস্কর্য ও মুরাল পেইন্টিং পাওয়া যায় এইযুগে বিশেষ করে ঘোরবন্দে। এই যুগের বৌদ্ধ শিল্পে গ্ৰীক প্রভাব অল্পই, বরং তুর্কী ও চীনা প্রভাব সুস্পষ্ট। ছবিতে কাবুলের কাছে পাওয়া পাথরের মৈত্রেয় মূর্তিটিতে গ্ৰীক ও চীনা দুরকম প্রভাব দেখা যায়। ৭৫০ সালের পর চীনা প্রভাব কমতে থাকে, কারণ তাং সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া থেকে পিছিয়ে আসে।

💮 শেষের শুরু:
তুর্কিশাহিদের খোরাশান জয়ের চেষ্টা উল্টে কাল হয়। আরবদের হাতে উল্টে পরাস্ত হয়ে তুর্কিশাহি রাজা ৮১৫ নাগাদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তবে ৮২২ সালে তুর্কিশাহি বংশকে সরিয়ে কাবুলের সিংহাসনে বসে তাদের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী কল্লর, শুরু হয় হিন্দুশাহি বংশ।

৭৯৫ সালে গজনির নিকটবর্তী তাপা সর্দারের শাহি বহার (অর্থাৎ রাজকীয় বিহার) ধ্বংস হয় মুসলিম আক্রমণে। এই ধ্বংসকাণ্ডের বিবরণ মুসলিম পর্যটক আবু আব্বাস অল য়াকুবির রচনায় আছে। এখানকার কিছু ভাস্কর্য ও পুঁথির ছবি দিচ্ছি। সফারিদ বংশের য়াকুব ইবন লেইথ, গ়জ়নির সবুক্তগিন নবম ও দশম শতকে একের পর এক আক্রমণ চালায় কাবুলে যার ফলে ঐ অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাল্খ অনেক আগে ৭২৫ সালেই খিলাফতের অধীনে চলে যায়।

💮 নওবহারের উত্তরসূরিরা:
বর্মকীয় পরিবার বাল্খে কণিষ্ক নির্মিত নওবহার বা নববিহারের রক্ষণাবেক্ষণ করত। ৭২৫ অব্দে বাল্খের পতনের পর ইসলাম গ্ৰহণ করার পর তারা নূতন মুসলিম শাসনেও বিশেষ ক্ষমতাশালী ছিল। সংস্কৃত প্রমুখ শব্দ থেকে বর্মক। এই পরিবারের য়াহয়া ইবন খালিদ অল বর্মকি (মৃত্যু ৮০৬) জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এবং প্রচুর সংস্কৃত বই বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রের বই পারসিক ও আরব ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। বাগদাদে হাসপাতাল খুলেছিলেন যেখানে ভারতীয় চিকিৎসকরা যেত। বাগদাদের খলিফা হারুন অল রশীদের প্রথমদিককার ডানহাত ছিলেন য়াহয়া বর্মকি। হারুনের তৈরি বাগদাদের গ্ৰন্থাগার “বায়াত অল হিকমা” জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার আন্তর্জাতিক স্থল হয়ে উঠেছিল, তাতে য়াহয়া ও ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষ অবদান আছে, আর পরোক্ষভাবে ইউরোপের রেনেসাঁতেও।

য়াহয়ার পুত্র জাফর বর্মকি প্রথম কাগজ তৈরির গোপন প্রযুক্তি চীনের বাইরে নিয়ে আসেন এবং বাগদাদে কাগজ কল তৈরি করান। এভাবেই পাশ্চাত্যে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি আসে। তারপর অবশ্য হারুন আল রশিদের সঙ্গে বর্মকীয় পরিবারের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে আর এই পরিবারের সবাইকে জেলে পাঠানো হয়, জাফরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, য়াহয়া বন্দিদশায় মারা যান, তবে এই পরিবারের কিছু লোক আবার নূতন করে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। জাফরের সঙ্গে হারুনের বোনের বিয়ে নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত, তবে মনে করা হয় বর্মকিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আর ইসলামপূর্ব সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের যোগ তাদের অনেক শত্রু তৈরি করেছিল।

য়াহয়া বর্মকি তিনটি বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক বই আরবি ভাষায় লেখান বা অনুবাদ করান- কিতাব অল বুদ্দ, বিলৌহর ওয়া বুদাসেফ, কিতাব বুদাসেফ মুফরাদ। বোধিসত্ত্ব এলেন নূতন নাম নিয়ে- বুদাসেফ।

💮 কাবুলের শেষ কাফের রাজত্ব:
তুর্কিশাহিরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। খ়্যায়রখ়ানার সূর্যমূর্তি ও গর্দেজ় গণেশ মূর্তি তার উদাহরণ। তাদের মন্ত্রীরা ব্রাহ্মণ হত। এরাই পরে হিন্দু শাহি প্রতিষ্ঠা করে। হিন্দুশাহি আমলে আফগানিস্তানের পশ্চিম অংশ অনেকটাই মুসলিম নিয়ন্ত্রণে। তাই চাপে পড়ে হিন্দুশাহিরা নিজেদের রাজধানী কাবুল থেকে সরিয়ে খাইবার পাক়তুনখোয়া অঞ্চলের হুন্দে (৮৭০ সালে), তারপর পাঞ্জাবের লাহোরে (১০০১ সালে) নিয়ে যায়। ৮৭০ সালে হিন্দুশাহী কাবুলের পতন হয়, ৯৭৫ থেকে ১০১১ সালের মধ্যে প্রায় পুরো আফগানিস্তানের ইসলামিকরণ হয়।

দশম শতকে বামিয়ানের গুহায় শেষবারের মত বৌদ্ধ চিত্রাবলী আঁকা হয়। ১০১১ সালে ঘোর জনগোষ্ঠী (ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক মহম্মদ ঘোরি এই গোষ্ঠীর) বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্ৰহণ করে, সুলতান মাহমুদের আক্রমণের পর। আফগানিস্তানের বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির অবসান হল। তবে একটা সনাতন গোষ্ঠী টিকে থাকে ১৮৯৫ সাল অবধি! পরবর্তী পর্বগুলোতে তাদের আলোচনা হবে, আর বামিয়ানেরও। সেইসঙ্গে দেখব ইসলামের মধ্যে বেঁচে থাকা নূতন বুদ্ধ- বুদাসেফ!

(চলবে)
© Sudipto Pal

ছবি:
১) ফোন্ডুকিস্তানের বুদ্ধ- পরনে মধ্য এশিয়ার তিন-পাতা শাল
২) ফোন্ডুকিস্তানের বৌদ্ধ ভাস্কর্য
৩) ফোন্ডুকিস্তানের দেয়ালচিত্র
৪) গজনির নিকটে তাপা সর্দারের বৌদ্ধ ভাস্কর্য
৫) তাপা সর্দারের পুঁথি
৬) তেগিন শাহের মুদ্রায় ইরানীয় অগ্নিদেব আজ়র
৭) তুর্কী শাহী মুদ্রায় অগ্নির দুদিকে দুই উপাসক
৮) খ্যায়রখানার সূর্যদেব
৯) গার্দেজের গণেশ
১০) কাবুলের নিকটে প্রাপ্ত মৈত্রেয়- কিছু গ্ৰীক, কিছু তুর্কী শৈলি।

তথ্যসূত্র:
1. Buddhism in Central Asia, by B.N. Puri.
2. The Spread of Buddhism (Handbook of Oriental Studies – Section Eight – Central Asia) by Ann Heirman, Stephan Peter Bumbacher
3. Buddhism in Iran An Anthropological Approach to Traces and Influences, by Mostafa Vaziri.
4. ReOrienting the Sasanians East Iran in Late Antiquity, by Khodadad Rezakhani
5. Wiki pages

সূত্র: সংগৃহীত।
লেখক: সুদীপ্ত পাল।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৭, ২০২১

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ