লেখক: সোহেল হাজং কেন্দ্রীয় সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
আজ জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘের থিমের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এই আন্তর্জাতিক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয় :আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’। আদিবাসীদের বর্তমান বাস্তবতায় এ প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বৈশ্বিক কভিড-১৯ মহামারির কারণে এবারও বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এ দিবস উদযাপনে নানা আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই দিবসটি এখনও পালন করা না হলেও আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও বিভিন্ন আদিবাসী ও আদিবাসীবান্ধব সংগঠনগুলো স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এ দিবসকে কেন্দ্র করে এবারও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এবারের থিমের সঙ্গে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’- টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এই মূল প্রতিজ্ঞার কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে; যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়েছে বলে মনে করি। কেননা, ২০১৫ সালের পর থেকেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আমাদের রাষ্ট্রের পূর্ণ অঙ্গীকার দিয়ে কাজ করে গেলেও আদিবাসীরা এখনও সব পর্যায়ে তাদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রের সবপর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে আরও জোর দিতে হবে।
এবারের থিমে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি বা অঙ্গীকারের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত জরুরি মনে করি। কেননা, শুধু শাসক ও প্রভাবশালী মহলের মধ্যেই কোনো চুক্তি করলে হবে না, চুক্তিটি হতে হবে সামাজিক, যেখানে প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের সম্মান ও মর্যাদাসহ অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম্মতি সুনিশ্চিত থাকে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদিবাসীরা, যারা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা ব্যবহারে নানা বৈষম্য ও অপমানের শিকার হয়েছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্নভাবে প্রান্তিকতা ও শোষণের শিকার হয়েছেন, তারাও এ সামাজিক চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
জাতিসংঘ বলেছে, নতুন সামাজিক চুক্তি অবশ্যই আদিবাসী মানুষের প্রকৃত অংশগ্রহণ এবং অংশীদারিত্বের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে, যার ফলে সবার সমান সুযোগ, অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকে।
আমরা দেখেছি, আদিবাসীদের ওপর অতীত ঐতিহাসিক অত্যাচার ও অনাচারের ভুল বুঝতে পেরে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রধানরা আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। আমরাও প্রত্যাশা করি, আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী একদিন আদিবাসীদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হবে, ঐতিহাসিকভাবে নির্যাতিত এসব মানুষকে দূরে ঠেলে না দিয়ে আপন করে কাছে টেনে নেবে! কোনো ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্ক, সংরক্ষিত বন, নিরাপত্তা ক্যাম্প, উন্নয়ন প্রকল্প নামে আদিবাসীদের আর কোনো ভূমি দখল করা হবে না! দেশের একজন প্রান্তিক আদিবাসী মানুষ কেমন আছে, সেই মাপকাঠি দিয়ে বিচার হবে রাষ্ট্র প্রকৃতভাবে কেমন আছে!
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭-এ আদিবাসীদের মৌলিক অধিকারগুলো উল্লিখিত রয়েছে। জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও এ ঘোষণাপত্রের পূর্ণ সমর্থন জানানো উচিত এবং বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, গত সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ ঘোষণাপত্র সমর্থন এবং আইএলওর আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠী কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষরের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ছিল।
কভিড-১৯ মহামারিতে কেউ ভালো নেই। কিন্তু মহামারির এ সময়ে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মহামারি অবস্থার প্রভাবে তারা আরও বেশি প্রান্তিক ও অসহায় হয়ে পড়ছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা এর মধ্যে অন্যতম। যারা সরাসরি স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে তো অবশ্যই, পরোক্ষভাবে খাদ্যের চরম সংকট ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর করোনার এই সময়েও তাদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কিন্তু থেমে নেই। ভূমি বেদখল, আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি শ্নীলতাহানি, আক্রমণ, হয়রানি এসব কর্মকাণ্ড পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের ওপর ঘটেই চলেছে। এই সময়ে আদিবাসী নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী লোকেরা আরও বেশি দুর্দশার শিকার হচ্ছে। হাজার হাজার আদিবাসী শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
জাতীয় দারিদ্র্য হারের চেয়ে আদিবাসীদের দারিদ্র্য হার এমনিতেই বেশি। এই করোনাকালে আরও অধিক সংখ্যক নতুন আদিবাসী দারিদ্র্য সংযুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা অত্যন্ত অপ্রতুল। আদিবাসীদের সংখ্যা ও অধিক দারিদ্র্য হার বিবেচনা করে যথাযথ সেবা বা মানবিক সহায়তা আদিবাসীরা পাচ্ছে না। এবারের জাতীয় বাজেটেও আদিবাসীদের জন্য আলাদা কোনো বিশেষ প্রণোদনার বরাদ্দ রাখা হয়নি এবং তাদের নাম উল্লেখ করে কোনো বক্তব্যও রাখা হয়নি। এভাবেই আদিবাসীরা বিভিন্ন পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ হতে বাদ পড়ে যাচ্ছে।
তাই এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি বিবেচনা করে রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডে আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা এখনই প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের সঠিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুন সামাজিক চুক্তি হওয়া প্রয়োজন।
করোনার এ পরিস্থিতিতে দেশের এই প্রান্তিক আদিবাসীদের সুরক্ষা প্রদানে রাষ্ট্রের সুনজর আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করি। আদিবাসীসহ সব নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, করোনা প্রতিরোধে টিকা প্রদান ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেহেতু তারা প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করে, সে জন্য তাদের মাঝে ওই সেবা নিশ্চিতকরণে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনা মহামারির কারণে চাকরিচ্যুত ও অসহায় আদিবাসী পরিবারের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনাসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রদানকালে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসীদের গুরুত্ব দিয়ে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা ও সেবা প্রদান নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া উচিত।
আদিবাসীদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে হবে এবং তাদের ওপর মিথ্যা মামলা, উচ্ছেদ, হয়রানি, শ্নীলতাহানি বন্ধ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ তারকা হোটেল, মৌলভীবাজারে খাসি পানচাষের গাছকাটা, মধুপুরে সংরক্ষিত বন, ইকোপার্ক ও বিভিন্ন প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা যাবে না। গাইবান্ধার বাগদা ফার্মের প্রকৃত ভূমির মালিক, সাঁওতালদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সূত্র: সমকাল।
তারিখ: আগষ্ট ০৯,২০২১
রেটিং করুনঃ ,