তখন সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট। আদালতকক্ষের লোহার খাঁচার ভেতর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁদের দুজনের মাথায় পুলিশের হেলমেট। শরীরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। এই দুজনের নিরাপত্তায় খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাঁচ পুলিশ সদস্য। এজলাস কক্ষে উপস্থিত বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাঁদের শাস্তি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। আইনজীবীদের কেউ কেউ মুঠোফোনে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন।
আইনজীবীদের স্লোগান ও হইচইয়ের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এই দুই ব্যক্তি এজলাস কক্ষের লোহার খাঁচার ভেতর দাঁড়িয়ে চুপ করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আনিসুল হক একপর্যায়ে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাও বলেন। তখনো আইনজীবীরা তাঁদের শাস্তির দাবিতে এজলাস কক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে বিএনপি সমর্থক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা অন্য আইনজীবীদের স্লোগান থামাতে বলেন। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে আদালতকক্ষে প্রবেশ করেন বিচারক। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে হকার শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে নিহত শাহজাহানের বাবাও এই দুজনের ফাঁসি চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আদালতে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এমনকি আত্মপক্ষ সমর্থন করে তাঁরা আদালতে কোনো বক্তব্যও দেননি। পুরোটা সময় আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান ছিলেন নিশ্চুপ। রিমান্ড আবেদনের পক্ষে যুক্তি শুনে বিচারক দুজনের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর তাঁদের নেওয়া হয় আদালতের হাজতখানায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এরপর থেকে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যসহ নেতাদের বেশির ভাগ আত্মগোপনে রয়েছেন। এর আট দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ আনিসুল হক ও আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়।
সকাল থেকে আইনজীবীদের অবস্থান, ডিম নিক্ষেপ
সদ্য বিদায়ী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আদালতে হাজির করা হবে—এমন খবর জানার পর বুধবার সকাল ১১টা থেকে ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে অবস্থান নেন বেশ কয়েকজন বিএনপি সমর্থক আইনজীবী। পরে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের শাস্তির দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। তখন কোনো কোনো আইনজীবীর হাতে ডিমও দেখা যায়। দুপুর ১২টার পর গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালতের সামনে অবস্থান নেন।
দিনভর এই পরিস্থিতি চলতে থাকার পর বিকেল পাঁচটার পর সেনাবাহিনীর একটি দল এসে আদালতের সামনে অবস্থান নেন। তাদের পরপর আসেন বিজিবির সদস্যরা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ তাঁদের ঘিরে রাখে।
মাথায় পুলিশের হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে দুজনকে আদালতের এজলাস কক্ষে থাকা লোহার খাঁচার ভেতর তোলা হয়। তাঁদের দুজনেরই পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপিসমর্থক আইনজীবীরা। তাঁরা আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের নাম উল্লেখ করে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান। প্রায় ১০ মিনিট ধরে এই আইনজীবীরা স্লোগান দেন। এ সময় লোহার খাঁচার ভেতরে থাকা আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে বিমর্ষ দেখা যায়। বেশ কয়েকজন আইনজীবী তখন লোহার খাঁচার দিকে তেড়েও যান। এ সময় আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কিন্তু আইনজীবীরা এজলাসের ভেতর শাস্তি চেয়ে স্লোগান দিতেই থাকেন। এই দুজনের ১০ দিনের রিমান্ড আদেশের পরেও আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। একপর্যায়ে একজন আইনজীবী আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের দিকে তেড়ে যান। তখন আইনজীবীরা তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও বারবারই তিনি লোহার খাঁচার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রায় দুই মিনিট এমন হট্টগোল চলার পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা ওই আইনজীবীকে এজলাস কক্ষ থেকে বের করে দেন।
পরে এজলাস কক্ষে উপস্থিত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইনজীবীদের এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন; কিন্তু আইনজীবীরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ না করে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা এজলাস কক্ষে প্রবেশ করে আইনজীবীদের বের হয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে অন্য আইনজীবীরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। এরপর আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে হাজতখানায় নেওয়ার উদ্যোগ নেন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা যখন আনিসুল হককে আদালতের সামনে দিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একদল লোক আনিসুল হককে লক্ষ করে ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করতে থাকেন। কয়েকটা ডিম আনিসুল হকের হেলমেটেও লাগে।
এ সময় আদালত চত্বরে প্রবেশের প্রধান ফটকের সামনে একদল মানুষ ঝাড়ু হাতে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের শাস্তি চেয়ে স্লোগান দেন। রাত আটটার পর দুজনকে প্রিজন ভ্যানে করে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
দুজনের বিষয়ে পুলিশের করা রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় শাহজাহান আলীকে এলোপাতাড়ি মারধর ও গুলি করা হয়। পরে সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহজাহান আলী মারা যান। এ ঘটনায় করা মামলায় আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে বুধবার সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাতে তাঁরা এই হত্যার ঘটনায় জড়িত বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের নাম–ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে।
নিউমার্কেট থানা–পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে, আনিসুল হকের কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে আনিসুল হকের পাসপোর্ট। একইভাবে সালমান এফ রহমানের কাছ থেকেও বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গেছে। জব্দ করা হয়েছে সালমান এফ রহমানের মুঠোফোন ও তাঁর ছয়টি পাসপোর্ট।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১৫, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,