লেখক: মোশতাক আহমেদ।
একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছিল ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক–স্নাতকোত্তর অর্থাৎ বিবিএ-এমবিএ পড়ার জোয়ার। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশের পছন্দের তালিকায় থাকত বাণিজ্যের বিষয়গুলো। কিন্তু এখন ভর্তিতে বাণিজ্যের বিষয়গুলোর দাপট কমছে। একই সঙ্গে কলা, সামাজিক বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতেও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তুলনামূলক কম। তবে সেই জায়গায় বিজ্ঞান, কৃষি, ফার্মাসি, প্রকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চার বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বিজ্ঞানের মৌল বিষয়গুলোতে এখনো তুলনামূলক আগ্রহ কম।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় চাকরির বাজারে বিবিএ-এমবিএর অনেক বেশি চাহিদা ছিল। সেই চাহিদার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবসায় প্রশাসন তথা বাণিজ্যের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ বেড়ে যায়। এ জন্য তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব বিষয়ের রমরমা ছিল।
সময়ের সঙ্গে তাতে পরিবর্তন আসছে। তবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কারণ, সামনের দিনগুলোতে বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ড আরও বাড়বে; বিশেষ করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানকে মূল পুঁজি করেই প্রস্তুত হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য
দেশের উচ্চশিক্ষার দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৮টি। এগুলোর মধ্যে অবশ্য ইউজিসির অনুমতি নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ৯৯টি। বাকি ৯টি এখনো তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী সাড়ে তিন লাখ।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী বিষয় ও পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; বিশেষ করে ল্যাবরেটরি সায়েন্স, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য সহায়ক হবে।
এ ছাড়া বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানভিত্তিক ডিগ্রি জাতীয় উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করছে সংস্থাটি। তবে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়লেও বিজ্ঞানের মৌল বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে ইউজিসি।
চার বছরের চিত্র
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসনে ছিলেন ৩৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। ওই বছর বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষিবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থী ছিল ৪০ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ফার্মাসিতে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তখন কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও আইন বিষয়ে শিক্ষার্থীর হার ছিল ২২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ১ শতাংশের কম ছিল সার্টিফিকেট কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও পোস্টডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থী।
কিন্তু চার বছর পর ২০১৯ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ শতাংশের বেশি কমেছে। এখন মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ দশমিক ১২ শতাংশ ব্যবসায় প্রশাসনের। বিপরীতে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষিবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন এই অনুষদে শিক্ষার্থীর হার ৪৮ শতাংশের বেশি। এই সময়ে ফার্মাসিতে ভর্তির হারও বেড়ে হয়েছে ৪ শতাংশের বেশি। কিন্তু কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও আইন বিষয়ে শিক্ষার্থীর হার সামান্য কমেছে, যা এখন ২১ শতাংশের বেশি।
ইউজিসির তথ্য বলছে, ধারাবাহিকভাবেই ব্যবসায় প্রশাসনে ভর্তির এই হার কমছে এবং বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে বাড়ছে। এর আগে ২০১৮ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে শিক্ষার্থী ছিলেন ২৮ শতাংশের কিছু বেশি। তখন বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থী ছিলেন ৪৬ শতাংশের বেশি, আর ২০১৭ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে শিক্ষার্থী ছিলেন ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, তখন বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষিবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থী ছিলেন ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
ব্যবসায় শিক্ষায় প্রশাসনে শিক্ষার্থী কমে যাওয়া এবং বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি হওয়ার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য চৌধুরী মোফিজুর রহমান বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম দিক থেকে শুরু করে বেশ কয়েক বছর আগেও বিরাট অংশ শিক্ষার্থী বিবিএ-এমবিএতে পড়ত। কিন্তু বাজারেরও একটি ধারণক্ষমতা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে হয়তো বাজারে আর সেই ধারণক্ষমতা নেই। আবার সামনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে, সরকারও ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণেও শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা বিবেচনায় নিলে এই প্রবণতা ইতিবাচক। সামনের পৃথিবীর জন্য নতুন প্রজন্মকে গুণমানসম্পন্ন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সবাই মিলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,