এমএফএস বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অ্যাপ দিয়ে এখন নিমেষেই অনেক পেমেন্ট সেরে ফেলা যাচ্ছে। ফোন রিচার্জ করা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ—সবই করা যাচ্ছে। কিউআর কোডের বদৌলতে ব্যাপারটা প্রকৃত অর্থেই সহজ হয়েছে। আর এই যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন হচ্ছে, সেটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল মুদ্রার কল্যাণে। গ্রাহকের হিসাবে জমাকৃত ডিজিটাল মুদ্রার বিনিময়ে এই কেনাবেচা সম্ভব হচ্ছে।
ব্যাপারটা হলো, অর্থ পরিশোধের জন্য এখন আর পকেটে নগদ টাকা বহন করার প্রয়োজন হয় না, এটা নতুন কথা নয়। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, তাও অনেক দিন হলো। এখন সেই কার্ডেরও প্রয়োজন নেই। স্মার্টফোন দিয়েও সহজে অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে। এসেছে ই-ওয়ালেটের ধারণা, যেখানে ডিজিটাল মুদ্রা গচ্ছিত থাকছে এবং প্রয়োজনমতো মানুষ তা ব্যবহার করছে।
এই বাস্তবতা দ্বৈত মুদ্রা ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে—সরকারি ও বেসরকারি অর্থ ব্যবস্থা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাতাবরণে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক, টেলিকম কোম্পানি ও পেমেন্ট কোম্পানি যে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তা আখ্যায়িত হচ্ছে বেসরকারি মুদ্রা ব্যবস্থা হিসেবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এই ব্লগপোস্টে বলা হয়েছে, এতে সরকারি ব্যবস্থাপনার ছায়াতলে বেসরকারি খাতের উদ্ভাবন গতি পাচ্ছে। নগদবিহীন লেনদেনের ভিত তৈরি হয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর।
ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তরতর করে বাড়ছে বিটকয়েনের দাম। এই মুদ্রায় লেনদেন নিরাপদ হলেও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির বাইরে। তবে চীন গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াও ডিজিটাল মুদ্রা চালুর ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, একসময় সারা পৃথিবীকেই ডিজিটাল মুদ্রার দিকে যেতে হবে। সহজ কথায় এর অর্থ হলো, আপনার জমানো টাকা একসময় ব্যাংক বা সিন্দুকে থাকবে না, তার জায়গা হবে ইন্টারনেটে। ভার্চ্যুয়াল জগতের এই মুদ্রাকেই বলা হয় ডিজিটাল মুদ্রা বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা।
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা চালু করবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। এখন কথা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা চালু করলে কি বেসরকারি কোম্পানির প্রচলিত ডিজিটাল মুদ্রা হারিয়ে যাবে, নাকি তা আরও বিকশিত হবে। আইএমএফের ব্লগপোস্টে বলা হয়েছে, দুটির মধ্যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। দুই ব্যবস্থা পাশাপাশি চলতে পারে। শুধু তা-ই নয়, একটি আরেকটির পরিপূরক হতে পারে। যেমন ব্যাংক হিসাবে যে টাকা গচ্ছিত আছে, সেটাই নোটে রূপান্তরিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কল্যাণে আস্থা স্থাপিত হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল যে কাজ, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ আরোপ, তা-ও ঠিকঠাক করে যেতে হবে।
অন্যদিকে মুদ্রা ব্যবস্থার এই দ্বৈত রূপ—সরকারি ও বেসরকারি—নতুন কিছু নয়, অনেক দিন ধরেই তা চলে আসছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বেসরকারি মুদ্রা অধিকতর উদ্ভাবনী ও ব্যবহারকারী-বান্ধব হওয়া সত্ত্বেও কেন সরকারি মুদ্রাকে ছাপিয়ে গেল না। উত্তরটা খুব মৌলিক—বেসরকারি মুদ্রার নিরাপত্তার জন্যই তাকে সরকারি মুদ্রার বাতাবরণে থাকতে হয়, তা সে নোট হোক বা কয়েন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ নির্ধারিত কিছু ব্যাংকে থাকতে পারে। সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য।
তবে নিকট ভবিষ্যতে ডিজিটাল ব্যবস্থা সবকিছু ছাপিয়ে যাবে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করবে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ব্লগপোস্টে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হবে উদ্ভাবনে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি অনেক অ্যাপ নির্মাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের সেবা এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা। অন্যদিকে ডেভেলপারদেরও কাজ হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে পেমেন্ট ব্যবস্থা পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা। ব্যবস্থাটা এমন হতে পারে, পণ্যের চালান বুঝে পাওয়ামাত্র এক ক্লিকে অর্থ পরিশোধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ব্যাপারটা শুধু আর ই-ওয়ালেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অথবা এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে শুধু ফোন নম্বরের ভিত্তিতে কারও কাছে অর্থ পাঠানো যাবে।
কাগুজে মুদ্রা ছাপানো ও বিতরণের ঝামেলার সঙ্গে আরেকটি বড় ঝামেলা হচ্ছে, ছেঁড়া নোট ধ্বংস করা। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে লেনদেনের হদিস থাকে না। দুর্নীতির সুযোগও থাকে বিস্তর। ডিজিটাল মুদ্রা সেই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তবে দরকার হচ্ছে উদ্ভাবনের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: মার্চ ১৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,