লেখক: আসিফ নজরুল।
আগস্ট শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর প্রায় পুরো পরিবারকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়। আগস্ট মাস এলে স্বভাবতই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আবেগপ্রবণ ও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেত্রীর ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণা হয়ে ওঠে মর্মস্পর্শী। আমাদের অনেকের মনে যে প্রশ্ন নিরুচ্চার হলেও থাকে, সেটিও তীব্র হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠে। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ—কেউ কেন রক্ষা করতে পারল না দেশের রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়ককে?
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্ব ছিল তখনকার সেনাপ্রধানের। আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকেই সরাসরি ফোন করেছিলেন। সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতিরোধের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ছিল ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারের। কিন্তু তাঁরা তা করতে পারেননি, বরং পরবর্তী সময়ের সাক্ষাৎকারে ব্যর্থতার জন্য পরস্পরকে দায়ী করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার চেষ্টা করেনি তাঁরই হাতে গড়া রক্ষীবাহিনী। বঙ্গবন্ধু হত্যার কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বরং তাঁর মৃতদেহ ৩২ নম্বরে রেখে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, রাষ্ট্রপতিসহ তার প্রতিটি সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগেরই নেতা। নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে অভিনন্দন জানান তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ ও বিডিআরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা এবং ভারত, আমেরিকা, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা।
ওপরে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তৎকালীন সেনা উপপ্রধান জিয়াউর রহমান তাঁদের কেউ ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য এখন সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাঁকেই।
২
আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর নানা ঘটনাচক্রে ও কিছুটা কপালগুণে (যেমন ’৭৫–এর ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে প্রাণে বেঁচে যাওয়া) এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হয়ে ওঠেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য মোশতাক আমলে প্রণীত কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইন হিসেবে বহাল রাখেন তিনি। এসব কারণে এবং বিশেষ করে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা কর্নেল ফারুকের একটি সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর আগে যোগাযোগ হয়েছিল—এমন দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নেতারা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে থাকেন। এ বছর তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক হিসেবেই তাঁকেই এখন দায়ী করা হচ্ছে।
আগস্ট হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যাঁদের পড়াশোনা আছে, তাঁরা এটি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলতে পারেন। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আগে প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে মিটিং হয়েছিল—এমন দাবি করেছিলেন আরেক ঘাতক কর্নেল রশিদ। খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীর একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া তথ্য অনুসারে, হত্যাকারী দলের সদস্যরা নাকি দেখা করেছিলেন পরবর্তী সময়ে জেলহত্যাকাণ্ডের শিকার দুজন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গেও!
ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল কর্নেল রশিদের বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা বলে তখনই অভিহিত করেছিলেন, ইউসুফ আলীর বক্তব্যও কেউ সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে মনে হয় না। শুধু জিয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত ও বাংলাদেশে ফিরতে নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় বিক্ষুব্ধ কর্নেল ফারুকের বক্তব্যকে কেন এতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পাওয়া যায়নি।
তবে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পুস্তক অনুসারে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কিছু ঘটতে পারে, জিয়ার কাছে এটুকু অনুমান করার মতো তথ্য বা ইঙ্গিত ছিল। এমন তথ্য ছিল সেনাপ্রধান, সেনা গোয়েন্দাপ্রধান, কিছু সেনা কর্মকর্তা, পুলিশের আইজি, এমনকি স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কাছেও। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিষয়টি কত দূর যাবে বা এটি আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার মতো কিছু কি না, এটি ভেবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি তখন কাউকেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে এরপরও জিয়াউর রহমান বা অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ কোনো প্রমাণ ছাড়া এত গুরুতর অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে তোলা সমীচীন নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চুলচেরা ও সুদীর্ঘ বিচারে কোথাও জিয়াউর রহমানের নাম আসেনি। তিনি তত দিনে পরলোকগমন করেছেন, কিন্তু পরলোকগত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকলে তা বিচারিক পর্যবেক্ষণে না উঠে আসার কোনো কারণ নেই। সরকার থেকে এখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পরিপূর্ণ তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই তদন্তের আগেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পক হিসেবে কাউকে দায়ী করলে তদন্তের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
৩
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সংশ্লিষ্টতার দাবি বা বিশ্বাস থেকেই সম্ভবত এখন তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানও এ প্রশ্ন তোলার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এটি দালিলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে কোর্ট মার্শালে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে হত্যা করে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক বীর উত্তম খেতাবও পেয়েছিলেন। জিয়া চট্টগ্রাম ও সিলেটে সম্মুখযুদ্ধও পরিচালনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিভিন্ন অবদানের উল্লেখ আছে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক প্রভাবশালী উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ, মুক্তিযুদ্ধের উপাধিনায়ক এ কে খন্দকারসহ খেতাবধারী আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার পুস্তকে।
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন না করার অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তিনি আঘাত হানেন সংবিধানের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে দিয়ে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র মূলনীতি ছিল না। গণপরিষদ বিতর্ক ও ১৯৭২ সালের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সবচেয়ে বিশদভাবে ও গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের কথা। এসব দলিল অনুসারে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সামরিক শাসন জারি, ভুয়া নির্বাচন, দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও স্বজনপ্রীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গুরুতর লঙ্ঘন। এমন কোনো না কোনো লঙ্ঘনের দায় বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের রয়েছে। এখানে আলাদা করে কাউকে দায়ী করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো অকাট্য সত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসন করেছিলেন। এটি অবশ্যই নিন্দনীয়, তবে বাস্তবতা হচ্ছে জিয়া-পরবর্তী চার দশকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি কোনো ক্ষমতাসীন দলই।
৪
বাংলাদেশ পৃথিবীর বিরল একটি দেশ, যেখানে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও রাজনীতির মূল উপজীব্য হচ্ছে ইতিহাসচর্চা। এই চর্চা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হয়। এই রাজনীতিতে লাভ কী হয় জানি না, কিন্তু মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি, অশান্তি আর বিভক্তি বাড়ে অনেক ক্ষেত্রেই।
ইতিহাসকেন্দ্রিক এই বিতর্ক জারি রাখা হয়েছে করোনাকালেও। এই মহাদুর্যোগে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো বছর দেড়েক যাবৎ বন্ধ রাখা হয়েছে, বহু মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার আরও অবনতি হয়েছে, উন্নয়নের গতি থমকে গেছে। আমাদের জাতীয় উদ্যম, সামর্থ্য আর মনোযোগ এসব বিষয়ে কেন্দ্রীভূত রাখা প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল অন্তত আপত্কালে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে জাতীয় সমঝোতার চেষ্টা করা।
৪০ বছর আগের কারও মৃতদেহ বা ৫০ বছর আগের তাঁর অর্জনকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বেঁচে থাকা মানুষের কল্যাণের কথা ভাবা।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ০৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,