লেখক:এ কে এম জাকারিয়া।
রাজনীতি নিয়ে এখন অনেকেই বেশ চাঙা বোধ করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে কয়েকটি বিভাগে বিএনপির ধারাবাহিক সফল জনসভায় সরকারবিরোধীদের অনেকেই বেশ উৎসাহিত। তাঁরা দেখছেন, নানা বাধাবিপত্তির পরও এসব জনসভায় দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা অংশ নিচ্ছেন।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, বিএনপি কী এমন কৌশল বা সাংগঠনিক উদ্যোগ নিল, যাতে কর্মী-সমর্থকেরা এতটা উদ্বুদ্ধ হলো! কিন্তু এর পাল্টা প্রশ্ন হলো, আসলেই কি এখানে কোনো কৌশল কাজ করেছে? নাকি সরকারি দল ও পুলিশের হামলা, মারধর ও গুলি বন্ধ হওয়াতেই সমর্থকেরা সমাবেশে হাজির হতে শুরু করেছেন? ভোলা, নারায়ণগঞ্জ বা মুন্সিগঞ্জে যা ঘটেছে, তা অব্যাহত থাকলে এসব জনসভা কতটা সফল হতো?
এখানে বলে রাখা ভালো, বিএনপির জনসভার আগে বাস, লঞ্চ বা নৌঘাটে ধর্মঘট বা পরিবহন বন্ধ রেখে যে ‘বাধা’ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে বাধা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগুলো নতুন কিছু নয়। এসব বাধা দূর করেই বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে।
বিএনপি যদি এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দাবিতে অটল থাকে আর আওয়ামী লীগ যদি শেষ পর্যন্ত ভেতর-বাইরের চাপ উপেক্ষা করে আগের মতো ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতির খারাপ সময় ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মধ্যে সামনের দিনের রাজনীতি নিয়েও জনগণকে ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে
বিএনপির জনসভাগুলো সফল হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ বা কৌশল আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি একটি বড় দল, এর কর্মী-সমর্থকেরা সুযোগ পেলে দলের কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারের দমন-পীড়ন ও প্রতিহিংসার মুখে পড়েছেন।
দু–দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই ক্ষমতা ধরে রেখেছে। ‘বিরোধী-পীড়নের’ কাজটি ভালোভাবে করতে না পারলে এটা সম্ভব হতো না। ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য পীড়নপর্বটি বেশ দীর্ঘই হয়ে যাচ্ছে। এখন একটু সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। তিন মাস আগেও আওয়ামী লীগ যতটা কঠোর ছিল, সেই একই অবস্থানে থাকলে বিএনপি কি এভাবে সফল কর্মসূচি পালন করতে পারত?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে? সরকারি দল কি ‘ভালো’ হয়ে গেল? নাকি চাপে পড়ল? পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে মনে হয় আওয়ামী লীগ চাপে পড়েছে। এই চাপ দুই দিকের। একটা ভেতরের, আরেকটা বাইরের। ভেতরের চাপটি মূলত অর্থনৈতিক। আমদানি-রপ্তানি, শিল্প উৎপাদন, দ্রব্যমূল্য, খাদ্য পরিস্থিতি, রিজার্ভের অবস্থা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যা শোনা যাচ্ছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নিজেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। দেশের অর্থনীতি দুর্দশার মধ্যে না পড়লে বিরোধী দলের প্রতি আওয়ামী লীগ এখন যতটা ‘নমনীয়তা’ দেখাচ্ছে, তা দেখাত বলে মনে হয় না।
অর্থনৈতিক সংকটের বাইরে যে ‘রাজনৈতিক’ কারণে আওয়ামী লীগ চাপে পড়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের অতিমাত্রায় ‘রাজনৈতিক সক্রিয়তা’। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বিশ্বের ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি ‘রাজনীতি সক্রিয়’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চ মাত্রায় এবং ২৯ ভাগ মানুষ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। এর মানে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। জরিপটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। আর ২০১৬ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এমন রাজনীতিতে আচ্ছন্ন দেশ আমি আর দেখিনি।’ (লাইভ মিন্ট, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬)।
‘রাজনীতি সক্রিয়’ জনগণের ‘রাজনীতিতে আচ্ছন্ন’ দেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছে। যে কায়দা ও কৌশলে এই দুটি নির্বাচন হয়েছে, তা জনগণের সামনে বিস্ময় হিসেবে হাজির হয়েছে। হতবাক হয়ে তাঁরা দেখেছেন, যে ভোটের রাজনীতি তাঁদের ‘রাজনীতি-সক্রিয়’ করেছে, সেই ভোটে তাঁদের আর কোনো অধিকার নেই। ভোট আর ‘উৎসব’ নয়, ভোট মানে নতুন কোনো কৌশল।
একই সঙ্গে ভোটবঞ্চিত জনগণ এখন টের পেতে শুরু করেছে, গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে ‘উন্নয়নের’ যে স্লোগান আওয়ামী লীগ সামনে নিয়ে এসেছিল, সেখানে বড় ফাঁকি রয়ে গেছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য যে শুধু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নয়—দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার বড় ভূমিকা রেখেছে, সেটাও জনগণের সামনে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
সবকিছু মিলিয়ে জনগণ আগামী নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আরেকটি নতুন কৌশল দেখতে বা বিস্মিত হতে চায় বলে মনে হয় না। জনগণের মধ্যে ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জোরদার হয়েছে। এসব বিষয় সরকার বা সরকারি দল জানে না, এমন নয়। ফলে নতুন কোনো কৌশল আদৌ কাজে দেবে কি না, সেই ভয় নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে আছে।
আর বাইরের যে চাপ সরকারের ওপর পড়েছে, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের চাপ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি নিয়েছিল, বাইডেন যে তা থেকে সরে আসবেন, সেটা তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেই ছিল। নির্বাচিত হয়ে তিনি সেই পথেই হাঁটা শুরু করেছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গণতন্ত্র সম্মেলন করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ইস্যু যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নজরে আছে, তা টের পাওয়া যায় মানবাধিকার ইস্যুতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায়। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোকেও একটি বার্তা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের মুখে দেশে গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত হওয়া নিয়ে উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, এসব ইস্যুতে পশ্চিমের চাপ বাড়বে বলেই মনে হয়। বিএনপি যে ছাড় পাচ্ছে, তার পেছনে আন্তর্জাতিক চাপের ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
একদিকে অর্থনীতির বাজে দশা, অন্যদিকে বিদেশি চাপ—এ দুই পরিস্থিতি বিএনপিকে মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছে। বিএনপি জনসভা করতে পারছে, এতে দলটির কর্মী-সমর্থকেরা উৎসাহ বোধ করতে পারেন।
কিন্তু এর ফলাফল কী? বিএনপি যদি এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দাবিতে অটল থাকে আর আওয়ামী লীগ যদি শেষ পর্যন্ত ভেতর-বাইরের চাপ উপেক্ষা করে আগের মতো ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতির খারাপ সময় ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মধ্যে সামনের দিনের রাজনীতি নিয়েও জনগণকে ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে।
**** এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক্
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:নভেম্বর ০৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,