লেখক:মামুন আল মোস্তফা।
চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। টানা তিনটিসহ মোট চার মেয়াদে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার বিরল সম্মানও তিনি প্রথম পাচ্ছেন। সুদীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষ নেতৃত্ব ও ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা প্রায়ই রাজনীতি থেকে অবসর নিতে ভয় পান। সার্বক্ষণিক কর্মতৎপর থাকার এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়। আর পুরোভাগের তুখোড় খেলোয়াড়ের জন্য সাইডলাইনে বসে থাকাটা বেদনাদায়কও বটে।
পরিণত বয়সের পাঠকের মনে থাকতে পারে, শেখ হাসিনা সাতান্ন বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা বারবার ঘোষণা করেছিলেন। তবে, সময় বদলেছে। এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভেতর এমন ধারণা (বা বিভ্রম) বদ্ধমূল হয়েছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব একেবারেই বিকল্পহীন, কিংবা এই মুহূর্তে তাঁর কোনো উপযুক্ত বিকল্প নেই।
দলটির দ্বাবিংশতম জাতীয় কাউন্সিল ২৪ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটের কারণে এবারের কাউন্সিল মাত্র এক দিনব্যাপী এবং আড়ম্বরহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। সকালবেলায় শেখ হাসিনা এই অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেবেন, তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কয়েক সহস্র কাউন্সিলর অধিবেশনে বসবেন এবং সন্ধ্যাবেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হবে।
কাউন্সিল অধিবেশনের জন্য যে সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসতে পারে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আমাদের জানিয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি নেতা-কর্মীদের আস্থা অবিচল হলেও কোনো না কোনো সময় তো রাজনীতিকে তাঁর বিদায় জানাতেই হবে। আর পুরোনো নেতার জায়গায় নতুন কেউ এলে—তা পরিকল্পিতই হোক আর অপরিকল্পিত—সব সংগঠনই একটি ক্রান্তিকালীন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়। এ সময় সংগঠনের বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে নতুনভাবে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষে সহযোগিতা ও বিবাদে জড়ায়। নয়া নেতৃত্বকে প্রায়ই বিবদমান পক্ষ ও স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়ের নতুন সূত্র খুঁজে নিতে হয়। নয়া নেতৃত্বের ইতি ও নেতিবাচক প্রভাব দলের ঐক্য-সংহতি, নীতি নির্ধারণ, জনগণের কাছে বৈধতা এবং সর্বোপরি আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনের ফলাফলে পড়ে।
অতীতে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তনের পরপরই তা ভাঙন বা উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলটি ভাঙনের শিকার হয়, একটি অংশ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের এবং অপরটি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একসারি নেতার অকাল তিরোধানে দলটি ভয়ানকভাবে নেতৃত্বের সংকটে পড়ে।
মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, আব্দুর রাজ্জাক বিভিন্ন নামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর দলটিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সুদৃঢ় হয়। তবে তাঁর বিদায়ে দলটি যে অনুরূপ সংকটে পড়বে না, সেটি বলা মুশকিল।
আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি তার শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তনের পরপরও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অকালমৃত্যুর পর কে এম ওবায়দুর রহমান ও শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপি টুকরা হয়েছে।
পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যদিও ২০০১ সালের পর থেকেই তারেক রহমানকে পরবর্তী শীর্ষ নেতা হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তারেক রহমানের নেতৃত্বকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা কিংবা অনেকের মতে পরোক্ষভাবে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ শীর্ষ নেতৃত্বকে দলের সব অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত না-ও জানাতে পারে। তবে, আগাম প্রস্তুতি থাকলে এ ধরনের পরিবর্তনের নেতিবাচক দিকগুলো কিছুটা এড়ানো সম্ভব। সে জন্য দলে নেতৃত্বের পরিবর্তনজনিত সংকট তৈরি হওয়ার আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, সে সব রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো পরিবারের মধ্যেই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের হাতবদল।
বিদায়ী নেতার পরিবার থেকে নতুন নেতা নির্বাচিত হন। তবে সেটা করতে হয় এলিটদের মতামতকে অগ্রাহ্য না করে, বরং তাদের আস্থায় নিয়ে। আওয়ামী লীগেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু যে অতীত নিয়ে সংগঠনটির অশেষ গর্ব, সেই সব সোনালি দিনে শীর্ষ নেতৃত্ব কখনো পরিবারকেন্দ্রিক ছিল না।
*****ড. মামুন আল মোস্তফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ডিসেম্বর ২৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,