দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরকার মালিক এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ। গতকাল রবিবার সকালে কারখানা খোলা হলেও দুপুরের পর বন্ধ করা হয়েছে ৪৫ কারখানা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কিছু কিছু শ্রমিক কাজ না করে হাজিরা দিয়ে কারখানার ভেতরেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন। আবার কোনো কোনো কারখানায় শ্রমিকরা হাজিরা দিয়ে বের হয়ে গেছেন।
এই অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কারখানার মালিকরা।
বিজিএমইএর তথ্য মতে, গতকাল সাত কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে কাজ না করে বিশৃঙ্খলা করেছেন। ১৬ কারখানায় কাজ না করে বের হয়ে যান; দুপুরের আগে ২৮ পোশাক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন কারখানার মালিকরা। পরে আরো ১০ থেকে ১৫টি কারখানা বন্ধ করেছেন মালিকরা।
এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত ছয়টি কারখানা জুলাই মাসের মজুরি দিতে পারেননি মালিকরা। জানা যায়, বিজিএমইএ সক্রিয় কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ১৫২টি।
এদিকে তৈরি পোশাক খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে অন্তত ১২০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাঁরা গত ১০ দিনের এই অসন্তোষের কলকাঠি নাড়ছেন। তাঁদের এই বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।
তাঁদের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ জন রয়েছেন শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও বহিরাগত এবং বাকিরা বিএনপি, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীর নাম। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের মজুরি সংকট নেই, রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতাদের আশ্বাস সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং শিল্প পুলিশের টহল জোরদার করার পরও কিছুতেই শ্রমিক অসন্তোষ থামানো যাচ্ছে না।
আবদুল্লাহ হিল রাকিব আরো বলেন, অভিনব কায়দায় চলছে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ। কাউকে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তিনি চিহ্নিত অসন্তোষকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে আজ (গতকাল) আবারও শ্রমিক নেতা, কারখানার মালিক এবং শিল্পাঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছি।
যৌথ বাহিনীর হাতে আশুলিয়ায় আটক ১০
সাভার সংবাদদাতা জানান, দুই সপ্তাহ আগে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে ঢাকার সাভার-আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। এতে পোশাকশিল্পে বেশ অস্থিরতা দেখা দেয়। এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিল্পোদ্যোক্তারা কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। শিল্পপাড়ায় স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে গত সোমবার যৌথ বাহিনীর অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যৌথ বাহিনীর তৎপরতা ও গ্রেপ্তার শুরু হলে গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত পাঁচ দিনে শিল্প-কারখানা বন্ধের সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় ১৭টিতে। আজ (রবিবার) শ্রমিকদের দাবির মুখে আশুলিয়ায় ৩০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে শনিবার রাতে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে চারজনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানার মোতালেব হোসেন (২৫), জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি থানার সেলিম রেজা (২১), ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানার মো. রাসেল (২৩) এবং নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার লিটন কুমার দাস (২৩)। আটক ব্যক্তিরা আশুলিয়ার নরসিংহপুর, ঘোষবাগ ও নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
টঙ্গীতে অভিন্ন দাবিতে চারটি শ্রমিক বিক্ষোভ
গাজীপুরের আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টঙ্গীতে চার দিন শান্ত থাকার পর আবার শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। অভিন্ন দাবিতে টঙ্গী এলাকায় চারটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা এসব বিক্ষোভ করেন। এতে টঙ্গী-জয়দেবপুর শাখা সড়ক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, টঙ্গীতে ১৪ দফা দাবিতে ন্যাশনাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং এমট্রানেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেড ও ব্রাভো এপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকরা ১৩ দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন ও বিক্ষোভ করেন। টঙ্গীর সাতাইশ এলাকায় বিক্ষোভ করেন প্রিন্স জ্যাকার্ড লিমিটেডের শ্রমিকরা।
টঙ্গী শিল্প এলাকায় অস্থিরতা তৈরির নেপথ্যে কারা!
গাজীপুর আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানান, টঙ্গীতে বিসিকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির পাঁচ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একাধারে ১৮ বছর ধরে একচেটিয়া ব্যবসা করে বিদায়ি সরকারের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের আমলে টঙ্গীর এই বিশাল অঙ্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসা-বাণিজ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় গোপনে বিএনপিও জড়িত ছিল। যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিএনপি জড়িত ছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানে এখন গোপনে আওয়ামী লীগও জড়িত আছে। মিলেমিশে একাকার হওয়ার এই হাতবদলের মিশনে বিএনপির একাধিক গ্রুপ নিজেদের ব্যবসার পাল্লা ভারী করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে।
কৌশলের মধ্যে বিএনপির ত্রাণ তহবিলে বেশি করে অনুদান দেওয়া, বিভিন্ন অজুহাতে আন্দোলন তৈরির মাধ্যমে কারখানার মালিককে ম্যানেজ করা আবার তথাকথিত শ্রমিক আন্দোলন ও ভাঙচুর থেকে কারখানা রক্ষার জন্য পাহারা কর্মসূচি অন্যতম। এসব মাধ্যম ছাড়াও গণমাধ্যমকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। এরই মধ্যে একাধিক গণমাধ্যমে বিএনপির একাধিক নেতার নাম উল্লেখ করে দখল ও ঝুটবাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে।
এসব প্রতিবেদনে গাজীপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ চারটি পদের মধ্যে দুটি পদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করতে কিছু কিছু গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। অতীতে যেসব গণমাধ্যমকর্মী আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁরা এখন বিএনপির নেতাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে ও চলমান সরকারকে অস্থির করতে কাজ করছেন।
অনুসন্ধান বলছে, টঙ্গীতে বড় তিন বিএনপি নেতার সৃষ্ট দুটি বড় গ্রুপ টঙ্গীর পাঁচ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্য এরই মধ্যে করায়ত্ত করে ফেলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা থেকে বাদ পড়া একাধিক বিএনপির গ্রুপ নানা কৌশলে দখলকারী সিন্ডিকেট থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য উল্লিখিত কৌশলগুলোও ব্যবহার করছে। ফলে টঙ্গীতে প্রতিদিনই কথিত শ্রমিক আন্দোলন চলমান রয়েছে। এই বড় শিল্পাঞ্চলের সব কারখানার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু বণ্টন শেষ হলে এসব আন্দোলন থাকবে না বলে অনেকেই মনে করছেন।
এসব বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া উইং থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি কোনো ধরনের দখলবাজি ও চাঁদাবাজিসহ যেকোনো ধরনের নৈরাজ্যকে বরদাস্ত করবে না। এরই মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দল থেকে বাদ দিয়ে মামলাও করা হয়েছে। এরপর আশা করি বিএনপির কেউ দলের আদেশ অমান্য করবে না। আর তা করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যা অব্যাহত আছে।
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৯, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,